যুদ্ধ কি শেষ? এরূপ প্রশ্নে পাল্টা প্রশ্ন আসবে এ আবার কেমন কথা? কথা যাই হোক, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়াও যায় না!
আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, ভৌগলিক সীমারেখা পেয়েছি, মানচিত্র পেয়েছি, জাতীয় সঙ্গীতও পেয়েছি। তবু মূল উদ্দেশ্য পুরো পূরণ হয়নি। যে উদ্দেশ্য জাতির পিতার ছিলো। কী ছিলো তার উদ্দেশ্য? তিনি আমজনতার অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। চেয়েছিলেন সোনার বাংলা। মুজিবের দুটি স্বপ্ন এখনো পুরোদস্তর বাস্তবায়িত হয়নি। সুতরাং বলা যায় যুদ্ধ শেষ হয়নি।
মুজিব নেই। যুদ্ধ কি থেমে গেছে? না। যুদ্ধ থেমে যায়নি। কান্ডারিও আছে। মুজিব তনয়া শেখ হাসিনা পিতার উচ্চকিত আঙুল থেকে যেন পাঠ নিয়েছেন। পিতার মতো তিনিও অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের জন্য আঙুল উঁচিয়েছেন। চেষ্টা করছেন আমজনতার মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার।
একা একা আর কিছু করা গেলেও দেশের কাজ কঠিন। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে।’ দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেকটা একাই ছুটছেন। চেষ্টা করছেন অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের কাজটি সম্পন্ন করতে। এ যুদ্ধে কাঙ্খিত ফলাফলের জন্যে প্রয়োজন একজনের নয়; প্রতিটি মানুষের, অন্তত নব্বই শতাংশ মানুষের স্বদেশপ্রেম। স্বদেশপ্রেমই তো দেশের চালিকাশক্তির নিয়ামক।
‘লক্ষ লক্ষ প্রাণের দাম অনেক দিয়েছি/সুদ ও আসলে আজকে তাই /যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য চাই।’ যুদ্ধ শেষের প্রাপ্য কি? এই প্রাপ্যটাই হলো বেঁচে থাকার জন্য স্বাভাবিক জীবনধারা। খাদ্য চাই, বস্ত্র চাই, আশ্রয় চাই, স্বাস্থ্য চাই, শিক্ষা চাই। মৌলিক চাহিদার বাইরে আরো কিছু চাই। যে চাওয়ায় থাকে শতদলে বিকশিত জীবন।
কোথায় সে জীবন? আছে তো। যেমন ছিলো পরাধীন দেশে। কতিপয় মানুষের স্বাচ্ছন্দ ভরা জীবন। কতিপয় মানুষের জন্য তো স্বাধীন দেশ নয়। কতিপয় মানুষের জীবনের জন্য যুদ্ধ নয়, রক্তপাত নয়, স্বাধীনতা নয়। স্বাধীন দেশ মানেই সব মানুষের স্বাভাবিক জীবন। তা হচ্ছে কই? যুদ্ধ শেষে প্রাপ্য অধিকার সব মানুষের প্রতিষ্ঠিত হয়নি। লুটেরা শ্রেণি ছিলো পরাধীন দেশে। লুটেরার দল স্বাধীন দেশেও আছে। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জরুরি লুটেরাদের মূলোৎপাটন। করবেটা কে? সাধারণ মানুষ? প্রশ্নই উঠে না। সাধারণ মানুষ তো প্রজার মতো। তাদের অনেকেরেই মেরুদন্ড নেই। থাকলেও নুয়ে নুয়ে হাঁটার কাজ চলে। জীবন চলে না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তারা মুখোমুখি হতে পারে না লুটেরাদের। শাসক শ্রেণিও তাদের দমন করতে পারে না। না পারার কারণ, শাসক শ্রেণি থেকে লুটেরাদের পৃষ্টপোষকতা আসে। শাসক শ্রেণির ভেতরেই থাকে লুটেরাদের প্রাণভোমরা। তারা যত্ন-আত্মি করে সেই ভোমরাকে বাঁচিয়ে রাখে। রাখার কারণ সহজেই অনুমেয়।
মুজিব একা ছিলেন না। বিশ্বস্ত সারথি ছিলো বেশ কয়েকজন। তারাও নমস্য। আজকের দেশের প্রধানমন্ত্রী অনেকটাই একা। তাঁর বিশ্বস্ত সারথি ক’জন আছে তা এক কথায় বলা কঠিন। তবে চাটুকার আছে। চাটুকার মুজিবের সময়ও ছিলো। আহত মনের আক্ষেপ থেকে তিনি বলেছেনও– ‘চারদিকে চাটার দল।’ আরো বলেছেন– ‘মানুষ সোনার খনি পায়, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ চাটুকার আর চোর জোটবদ্ধ হতে পারে সহজে। দিন যাচ্ছে, সংখ্যা এদের বাড়ছে। বাড়ছেই কেবল, এখন তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সাধারণ মানুষ, ভালো মানুষ, সৎ মানুষ আজকের দেশে অসহায়। ফলে মুক্তির লড়াই মুখ থুবরে পড়ে আছে।
শেখ হাসিনা অকাতরে পিতার মতো ভালোবাসা দিচ্ছেন দেশের মানুষকে। ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসার প্রত্যাশা থাকতেই পারে। শেখ হাসিনার প্রতি ভালোবাসা তখনই প্রতিয়মান হবে যখন মানুষ দেশ, দেশের মানুষকে ভালোবাসবে। তবে কি শেখ হাসিনাকে ভালোবাসেন না দেশের মানুষ? বাসেন তো। সাধারণ আমজনতা। চাটুকার, চোর যতো না হাসিনাকে ভালোবাসেন তার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন শাসন ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে নিজের আখের গোছাতে। ভালোবাসায় সততা না থাকলে দেশের কর্ণধার, দেশের সাধারণ মানুষ কেউ নিরাপদ নয়।
সত্তরের নির্বাচনে মুজিবের আবেগঘন ভাষণ ছিলো। সে আবেগ নিছক আবেগ ছিলো না। আবেগে আত্মপ্রত্যয়ও ছিলো। তিনি বলেছিলেন– ‘কোনো নেতা নয়, কোনো দলপতি নয়, আপনারা বাংলার বিপ্লবী, ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক ও সর্বহারা মানুষ রাতের অন্ধকারে কারফিউ ভেঙে মনু মিয়া, আসাদ, মতিউর, রুস্তম, জহুর, দোহা, আনোয়ারার মতো বাংলাদেশের দামাল ছেলেমেয়েরা প্রাণ দিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলে আমাকে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কবল থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিনের কথা আমি ভুলে যাইনি, জীবনের কোনোদিন ভুলবো না, ভুলতে পারবো না। জীবনে আমি যদি একলাও হয়ে যাই, মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মতো আবার যদি মৃত্যুর পরোয়ানা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, তাহলেও আমি শহীদের পবিত্র রক্তের সাথে বেঈমানী করবো না। আপনারা যে ভালোবাসা আমার প্রতি অক্ষুণ্ণ রেখেছেন, জীবনে যদি কোনোদিন প্রয়োজন হয় তবে আমার রক্ত দিয়ে হলেও আপনাদের এ ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করবো।’
মুজিব রক্ত দিয়েই ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করে গিয়েছেন তবে সোনার বাংলার কাজ সমাপ্ত করে যেতে পারেননি, পারেননি অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধ শেষ করে যেতে।
সংগঠিত হওয়ার সময় বহে যায়। আমজনতা সংগঠিত না হলে অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব। মুজিব নেই। দেশপ্রেমিক জনতাও নেই। যারা আছে তারা বিচ্ছিন্ন। আমজনতাকে কে সংগঠিত করবে! আমরা বলি শরৎচন্দ্রের মতো– ‘সড়কি লও, বন্দুক লও। লও তো বটে কিন্তু আনে কে।’ দেশপ্রেমিক যারা তারা অসহায়। দুর্বৃত্তরা সংগঠিত। তাদের মাথার উপর দিয়ে কিংবা তাদের সামনে দিয়ে সড়কি বা বন্দুক আনার লোক নেই। ফলে অর্থনৈতিক মুক্তির পথ আসছে না। কবে আসবে তাও অনিশ্চিত। মুক্তির যুদ্ধটাও অনিশ্চিত। তবে আশাবাদী মানুষ আমি। আশা বেঁধেই পথ চলি। সংগতই বলি– সময় আসবে, মুক্তির লড়াই মারাত্মক আকার ধারণ করবে। বাংলার গহ্বরে লুকিয়ে আছে সেই যুদ্ধের বীজ। আমজনতার অর্থনৈতিক মুক্তির পতাকা একদিন বাংলার আকাশে উড়বেই।