রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, গ্রীষ্মকাল
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, গ্রীষ্মকাল

মহাকালের কবি ও কবিতা

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

মায়ের মানিওর্ডার

চাঁদও মায়ের মতন আমাদের সাথে সাথে থাকে,
জোছনা এবং স্নেহাদর সমান্তরাল।
মন্ট্রিয়লে হোটেল ম্যারিয়টে
ভিসাকার্ড হারানোর সাথে সাথে পেয়ে যাই মায়ের গয়না বেচা মানিওর্ডার।

মা নিজেই একটা হাসপাতাল,
আমি তাঁর ভালোবাসার হাসপাতালে থাকি
আমি তাঁর খামারে বাস করি,
আমি তাঁর কুসুম অথবা কোমল কস্তুরি, কান্নার আনন্দ।
তিনি জাদুঘর; আমি তাঁর প্রত্নতত্ত্ব।

আমার সুগন্ধি মাকে আমি লুকিয়ে রাখি
আমার কবিতার ভেতর, শব্দের বন্ধনে–
পাতার গভীরে শাদা-শাদা শাদাফুল হৃদয়ের আড়ালে।
একাক্ষর শব্দটি অফুরন্ত সৌরভ!
শান্তি, ওঁম শান্তি! ওঁম শান্তি!

পি পু

পা তুলে পি করলো, ঘাসের ঘ্রাণ শুঁকে পু করলো। পার্কে।
পলিথিনে তুলে নিলে যত্নে।
তাকে নিয়ে দৌঁড়াও টাইম ওয়াচ বেঁধে–
আপেল গাছের ছায়া থেকে চেরি গাছের নিচে,

প্রাতঃ নয়; অপরাহ্ন ভ্রমণে পাঁচ হাজার স্টেপ চক্কর খাও।
হঠাৎ দাঁডিয়ে অন্য কুকুর দেখে
লাফঝাঁপ দিয়ে ঘেউ-ঘেউ করলে টেনে ধরো লাগাম।
কাঠবিড়ালির সাথে যখন খেলে–
তখন তোমার চোখে-মুখে কী যে আনন্দ, তৃপ্তি!

ওর ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার নিয়ে তুমি চিন্তিত
ঠিক করা আছে ডে-কেয়ারে রাখো।
দু’সপ্তার জন্য ফ্রান্স ট্যুরে গেলে রেখে যাও পেইংগেস্ট,
গান্ধীর ছাগলের মতো সাথে নিলেই পারতে।

এক সাথে জিওগ্রাফি চ্যানেল দেখো
জ্বরে পড়লে সারারাত অস্থিরতায় ওর সাথে ঘুমিয়ে থাকো!
ভ্যাকসিনের জন্য নিয়ে যাও এনিম্যাল হসপিটালে,

উইন্টার ড্রেসের জন্য পেডশপে যাও,
তোমরা দু’জনেই নিঃসঙ্গ!
তাই ছাগী পাল দেওয়ার মতো
ওর জন্য অনলাইনে খোঁজো সেক্সপার্টনার।

কিন্তু একজন মানুষকে সেই মর্যাদা দিলে না,
হৃদয়লালিত প্রিয়জনের চেয়ে গৃহপালিত গুরুত্ত্বপূর্ণ!

 

▪️

আমিনুল ইসলাম

ডানাওয়ালা বৃক্ষ

একটি বৃক্ষ ওড়ে আকাশ হতে আকাশে
সবুজ ডানারা চুমে অরুন্ধতির মুখ
কচিপাতাদের লক্ষ্য ছায়াপথের ঝর্ণা।

বৃক্ষটি কি পূর্বজনমে পাখি ছিল?
হয়তো ছিল-হয়তোবা ছিল না;
তর্ক ভেঙে তার নাম দেয়া যায় উড়বৃক্ষ।

বৃক্ষের শেকড়ে অন্তহীন ইলাস্টিসিটি
সে পেয়েছে স্বাধীনতার অবাধ আকাশ
অথচ বিচ্ছিন্নতার উস্কানি নেই ডগায়।

অদ্ভূত এই বৃক্ষের ডানায় শেকলছেঁড়া-জোর
কিন্তু রসসঞ্চারী ওই জড়গুলো ছিন্ন হওয়ার নয়।
তাই জলমাটির শিথিলবাঁধনে বারবার ফিরে আসা ।

প্রাচ্যের অসুখ

এটা কোনো প্রাচ্যতত্ত্ব নয়, অপ্রিয় বাস্তবতা এই যে
প্রাচ্যের শরীরে এক কঠিন রোগের আনাগোনা আজ;
সে-রোগ সংক্রমণে দিনদিন মানব-জঙ্গল হয়ে উঠছে
শত সভ্যতার সূতিকাগার– পূবের দুনিয়া! অথচ

প্রথমদিনের সূর্য একদিন উঠেছিল এখানেই ছড়িয়ে
দিতে তার আদি প্রভাতের আলো আর টর্চ হাতে
সভ্যতাও রেখেছিল প্রথম পা। আর আজ মহামনিষীরা
জন্মরুদ্ধ; শুধু গড়পড়তা কোলাহল আর মণিধারী সাপ!

দ্যাখো দূরে– মধ্যপ্রাচ্যে-আফ্রিকায়
দ্যাখো কাছে– দুপাশের পড়শি ভূগোলে
ভেসে যায় প্রেম!
ভেসে যায় অহিংসা!
ভেসে যায় শান্তি!

ভেসে যায় ন্যায়বিচার!
বানে ভেসে যাওয়া শস্যের উপমা এর চেয়ে ভালো
আর কোথায় পাবে?
আর বনের আকাশে ওঠা চাঁদের পিঠে চড়ে দ্যাখো–
দুর্বলদের ভেড়া জ্ঞানে নিজেদের নেকড়ে-ভূমি
রচনায় তৎপর সনখর সবলের দল!

কোনো মানবীয় ঘ্রাণ নয়,
অলৌকিক খোশবুও নয়,
তাদের শরীর থেকে বের হয়ে আসে
জিঘাংসা ব্রান্ডের বিকট গন্ধ
যা হারামেন মদিনা কিংবা টমফোর্ড ওদ উড স্প্রে করেও
চাপা থাকে নাকো!
কসমেটিক কোম্পানি, তাহলে তোমাদেরও ব্যর্থতা আছে!

এবং কোনো ধর্মগুরু নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানীও নয়
ধর্মের নিতম্ব থেকে–
এ রোগের জীবাণু আবিস্কার করেছেন
মিথ্যার স্মৃতির মিনার…

▪️

ওবায়েদ আকাশ

গন্তব্যপ্রকার

তোমার আমার গন্তব্য থাকে
পাখিদের পুরোটা আকাশ

গন্তব্যেরও গন্তব্য থাকে?
মাঝ রাতে ঝুলে থাকে দ্বিধান্বিত চাঁদ

পেঁচার দুচোখে ঘুমায় রাতের গন্তব্য কিংবা
ঘুমন্ত শিশুটির মুখে স্নেহের বিশ্বাস

ভুল করে উড়ে গেলে পারাবত সারি
কত দূর ডানা মেলে ওড়ার অভিলাষ?

একক গন্তব্য যারা রচিয়াছে জ্ঞানে
তারা কি ফিরেছে কেউ, জাল ফেলে নক্ষত্রজলে?
নাকি তারা পৃথিবীর প্রত্ন-ইতিহাস?

মিথের ঘোড়ারা কেউ পাড়ি দিয়ে সিন্ধু বিবিধ
ফিরেছে কি লক্ষ্যভ্রষ্ট নীড়ে?
আজব ঘোড়ার দেশ বিপুল পতাকা তুলে
গড়েছে তো অবিভাজ্য মানচিত্র নিবাস

পাটাতন খুলে যদি জল ওঠে, চোরা স্রোত ভাবে
আমার লক্ষ্যটি আজ বেঁচে গেল দীর্ঘায়ু পেয়ে

প্রতিটি শিকার যদি একক নিষ্ঠতা পেত
প্রতিটি লক্ষ্যই পেত কাঙ্ক্ষিত সুখ-সমাচার!

তোমার কি গন্তব্য তবে কিংবা আমার?
মাতাল তরঙ্গজুড়ে চেয়ে দেখো লাল নীল অগণিত
গন্তব্যপ্রকার

আমাদের নির্বাণকাল

তারকাঁটায় হেঁটে হেঁটে একদিন ঠিক পৌঁছে গিয়েছিলাম
নিষিদ্ধ শরীরী বিদ্যায়
আমার শরীর তা জানে
যেভাবে তোমার অতীত তা মানে

এতদিন পর স্মৃতিচারণের মতো চিহ্নগুলো
গলায় ঝুলিয়ে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য প্রদর্শন করে চলেছি

আমাকে দেখলেই তোমাদের গৃহপালিত নদী
মুখ লুকায় উত্তাল দিনের সামুদ্রিক সন্ত্রাসে
তোমাকে দেখলেই আমাদের প্রহরারত মাঠে
অশ্বদৌড় কেঁপে ওঠে মধ্যরাতে অকুণ্ঠ উত্তাপে

আজকাল ঊনঘুম ঊনঅন্নে রাত জেগে তীর্থ রচনা করি
পুরনো নোটবই ঘেঁটে অনাবশ্যক বাক্য কেটে
ভুল শুধরে নিই

আজকাল গঞ্জে-বাজারে ঘুরি, নানা বরণ মানুষ ঘেঁটে
চোখে চোখে খুঁজে দেখি শরীরী সম্পর্কের ভাষা

আমাদের এই বিদ্যা ভেসে উঠেছিল
ঢলে পাওয়া কইমাছের দিনে; আজও কেউ জানেনি তো
দুজনেই মজে আছি সেই এক চিরকালীন নির্বাণের ঋণে

 

▪️
রবিন পারভেজ

হ-৫

এক কাপ চা দিতে বলে আমি দোকানিকে বললাম
ভাল বিস্কুট কী আছে;
এলার্জি খান, খুব ভাল।

পোড়া লাল লোহা জলে ডুবালে যেমন বুদ্বুদ ওঠে,
আমি যেন তেমন বুদ্বুদ,
কামারের চৌবাচ্চায়, বলি
এইডা কী বিস্কুট রে, সত্যি ভাল?
হ সাহেব। খাইলে শক্তি বাড়ে।
আমি নীরবে এলার্জি হজম করি।

উচ্চারণ যাই হোক ভেতরের নিগূঢ় অর্থটাই আসল,
উচ্চারণে ঠাটবাট আর ভেতরটা অর্থহীন এমন
প্রতিমার ভিড়ে!

হ-১৬

একটা পাখি শূন্যে উড়ছে। পাখা মেলছে। পাখা
দোলাচ্ছে। ডিগবাজি খাচ্ছে।

সামনে নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই। সে তবু নির্দিষ্ট পথেই
চলে যেতে পারে…

একটা মানুষ জমিনে হাঁটছে। পা ফেলছে। বাঁক নিচ্ছে।
গন্তব্য ভাবছে।

সামনে বহু বহু নির্দিষ্ট রেখা টানা আছে। সে তবু
অনির্দিষ্টের দিকেই চলে যেতে পারে…

একটা পাখি
একটা মানুষ
পরস্পরের দিকে তাকায় আর দীর্ঘশ্বাসে ভরে ওঠে মাঠ।

মাঠভর্তি সবুজ পাতাগুলি আরও সবুজ হয়ে ওঠে…

 

▪️

মাসুদ পথিক

জীবন বলে কিছু নেই

‘জীবন বলে কিছু নেই’ এই বাক্য বোধিবৃক্ষের গায়ে লিখে
অরণ্যে মিলিয়ে গেছে যে সাধু
তার হৃদপিণ্ডে ঘুরঘুর করছে এখন করপোরেট ছুঁচু
তার ছায়ায় বসে জাপটে চুমু খাচ্ছে অ্যারোগ্যান্ড যুগল

আর কোথাও তাড়া খাওয়ার হরিণের কান্না শোনা যায়
কোথাও ছুঁড়ে মারা এইসব হালুম;
কিনে নিয়ে যাচ্ছে সুযোগসন্ধানী শিকারি

মেঘে মেঘে কেঁপে কেঁপে উঠছে বোধিবৃক্ষ
ভেসে যাচ্ছে জবজবে হাওয়া বয়ে নিয়ে যুগলের অর্গাজম
যেদিকে মৃতদের চিন্তারেখা নিয়েছে বাঁক

অতএব ‘আকাশ বলে কিছু নেই’ এই কথাটি গোপনই থাক
সাধু চাতুর্যের পৃথিবীতে মূলত এক বক

পাটা ও পোঁতা এবং বিলুপ্ত সে গ্রামীণ প্রণয়

তথাপি পাটা ও পোঁতার সঙ্গমস্থানে মরিচের গলাবাজি থেমে গেলে
ঘরের খোয়ারে পৃথিবীর শেষ মোরগ ডেকে ওঠে;
মেয়েটির ঝলানো বুক ঘেঁষে

ঘড়ার থেকে লাফিয়ে পড়া কৈ মাছের তৈরি করা পথ ধরে
হেঁটে যায় প্রাণ কোম্পানির নিরীহ সেলসম্যান
আঙিনার ঝাড় দেয়া থামালে দ্বীপেন চাষার ছোট কন্যা
সেলসম্যান হাওয়ায় ছুড়ে মারে কুণ্ঠিত এক চুম্বন
ক্ষুধার্ত ভাতহালিক এসে ঠুকরে খায় চুম্বনের মায়াবী গা

সীমান্তের দিকে, ঘন হয়ে আসে অচ্ছুৎ মেঘ
মেঘে মেঘে সম্পর্কের সংসার ভরে জড়ো হয় রোদের বিভাজন
চোখের নিরবিচ্ছিন্ন জলাশয় থেকে উড়ে যায় সব দাড়কিনা মাছ

মেয়েটির জীবনে আজও, আছে কী? খই ফোটানো কথার স্ফূরণ
যখন মুক্তবাজারে এসে গেছে হাইপারসনিক দানো
তবুও, হারিয়ে যায় না এইসব মায়া ও অনুভব

কেবল, কেবল মরে গেছে মরমিয়া মুহূর্তের বিচ্ছুরণ
সর্বহারা চাষার চোখে আজ কাঁটাতার আর জলের বিকিরণ

আবার ফিরে আসুক, আসুক-না পণ্যের ভারবাহী সেলসম্যানের বিরহী গানগুলি
যে-পথে স্মৃতিরোমন্থন পাখির কলরব, ঘাসের কাকলি

আর
পাটা ও পোঁতার ধ্বনিবহুল ভোর, আহা স্বপ্নের সমূহ অনুভব
দ্বীপেন চাষার মেয়েটি সীমান্তের এপার ও ওপারে, কাঁদে নিরবধি…!

এই বিভাগে আরো পড়ুন

কয়েক ফোঁটা স্মৃতির মধু

কবিতা প্রসঙ্গে নানা অনুষঙ্গ খুব স্মৃতিকাতর করে তোলে আজকাল। কনটেক্সট ছাড়া যেমন টেক্সট হয় না, অনুষঙ্গ ছাড়াও প্রসঙ্গ তেমনি গুরুত্ব হারায়। মাঝে মধ্যে ভাবি স্মৃতিই

দেদীপ্যমান কবি ও কবিতা

ফরিদা ইয়াসমিন সুমি কবিতা ও প্রেম তোমার হৃদকম্পনের অনুবাদ করতে গিয়ে ক্রমান্বয়ে অণুগল্প, ছোটগল্প, বড়গল্প হয়ে উপন্যাস হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ করবার পরে নিবিড় বিস্ময়ে লক্ষ্য

মহাকালের কবি ও কবিতা

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল মায়ের মানিওর্ডার চাঁদও মায়ের মতন আমাদের সাথে সাথে থাকে, জোছনা এবং স্নেহাদর সমান্তরাল। মন্ট্রিয়লে হোটেল ম্যারিয়টে ভিসাকার্ড হারানোর সাথে সাথে পেয়ে যাই

যুদ্ধ শেষ যুদ্ধ আছে

যুদ্ধ কি শেষ? এরূপ প্রশ্নে পাল্টা প্রশ্ন আসবে এ আবার কেমন কথা? কথা যাই হোক, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়াও যায় না! আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, ভৌগলিক