রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, গ্রীষ্মকাল
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, গ্রীষ্মকাল

গন্তব্য

kobila

আমি আপনার মার কবরে যাবো।

আমার মার কবরে? কেন?
নালিশ জানাতে।
নালিশ? কার বিরুদ্ধে?
আপনার বিরুদ্ধে।
কবর চিনবে কী করে?
কেন নাম দেখে, হোসনে আরা।
আমি একটু মুচকি হাসি, কী অবুঝ! কী অর্বাচীন। নাম দেখে কবর চিনবে? কী নালিশ করবে?

বলবো আপনার ছেলে আমার কথা শুনছে না।

এই পৃথিবীতে আমার মা আমার একমাত্র দুর্বলতা এই সত্য আমি এই নারীর কাছে পেশ
করেছি। আমার মার কোনো নির্দেশ আমি অমান্য করি না, এই সত্যও এই নারীকে ব্যক্ত করেছি।
আমি হাসি হাসি মুখে বলি মুসলমানদের কবরে গিয়েছো কখনও?

না যাইনি, কিন্তু তাতে কী? যাবো।

তোমার ভয় করবে না?

কেন? ভয় করবে কেন?

না, এত মানুষ ওখানে শুয়ে আছে। আর কবরস্থানে কত কিছু থাকে।

তাতে আমার কী? আমি তো যাবো হোসনে আরার কাছে।

অর্চনার সাথে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে ছয় মাস। খুব স্নিগ্ধ একটা মেয়ে। টানা ভ্রু টানা টানা চোখ, মুখটা ঢলঢল সৌন্দর্যের। হিন্দু মেয়ে, একটু রক্ষণশীল। প্রথমে যখন পরিচয় হয়েছিলো তখন নিজেকে কেমন আড়াল করে রাখতো। খুব আড়ষ্টতা, খুব লজ্জা। নিজেকে খুলে দিতে অনেক বেশি সংকোচ করেছিলো ও। আমি এসব লজ্জা ভাঙ্গার কৌশল খুব ভালো জানি। তারপর এখন যখন ওর সাথে আমার সবকিছুর বিনিময় চলছে তখন ও অনেক বেশি আগ্রাসী হয়ে ওঠছে বিশেষ করে ভালোবাসার ক্ষেত্রে। আমাকে কাছে পাওয়ার ক্ষেত্রে।

এ বিষয়গুলো আমার কাছে নতুন নয়; মেয়েদের বৈশিষ্ট্যই হলো ওরা সহজে ধরা দিতে চায় না। আর ধরা দিলে আর ছাড়তে চায় না। তখন অক্টোপাসের মতো পেঁচিয়ে ধরে। অর্চনা আমাকে এখন সেভাবেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে চাইছে না। শয়নে আমি, স্বপনে আমি, জাগরণে আমি, এরকম একটা অবস্থা চলছে ওর।

আমি ব্যস্ত থাকি। তার ওপর আমি একজন সৃজনশীল মানুষ। ওকে আমার ভালো লাগে। আমি ওকে চেয়েছি। প্রত্যেকটি সম্পর্ককে আমি খুব মূল্যায়ন করি। আলাদা আলাদাভাবে সম্পর্কগুলো উপভোগ করি। নতুন দৃষ্টিতে দেখি। নতুনভাবে বিবেচনা করি। প্রত্যেক নারীর গন্ধ আলাদা, আর্কষণ আলাদা। সবাইকে আমি ভালোবাসি। যাদের সাথে আমার সম্পর্ক বিগত শব্দে পরিণত হয়েছে তাদের কারো কারো প্রতিও আমার প্রেম অটুট। আমার মনে হয় আমি আবার পৃথিবীতে আসবো কাউকে কাউকে ভালোবাসার জন্য। কিন্তু একেবারে মরে কেটে ভালোবাসতে হবে কেন? এতো দিব্যি দিয়ে শপথ করে ভালোবাসতে হবে কেন? আমার কাছে মনে হয় ভালোবাসা নবায়নযোগ্য। প্রতিমুহুর্তে নতুন কারো মধ্যে, নতুন কারো মাধ্যমে এটি নবায়িত হয়। আমিও ভালোবাসাকে নবায়িত করি। ভালোবাসা আমাকে নবায়িত করে। মরি বাঁচি একজনকেই ভালোবাসি। ভালোবাসার কষ্টে কষ্টে মরে যাই এগুলোতে আমি বিশ্বাস করি না।

অর্চনা মেয়েটার বয়স আমার থেকে বেশ কম। ওর অনেকগুলো জিনিস আমার কাছে বেশ ভালো। কিন্তু মানসিকভাবে ও এত উচ্চতায় চিন্তা করতে পারবে না। অবশ্য ওকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। এ বয়সে প্রেম ভালোবাসা মানেই হচ্ছে সুপারগ্লু দিয়ে সেটে রাখা। আর সামান্য বোটা খসলেই শেষ। হায় হায় একি হলো! কী হারিয়ে গেলো! কী হারিয়ে যাচ্ছে! ভালোবাসার মুক্ত ও সুন্দর দিকটা বোঝার মতো পরিপক্কতা আর উদারতা এ-বয়সে না থাকারই কথা। আর শুধু বয়স না, মেয়েদের এটা থাকেও কম। ওর ভালোবাসাও আমাকে পাগল করে ফেলেছে। ভালোবাসায় ও একবারে কাবু হয়ে আছে। আমার সঙ্গ ওর প্রতি মুহুর্তের কামনা। ওর সঙ্গের একটা আলাদা গন্ধ ও আনন্দ আছে। ওকে পছন্দ করি। কিন্তু ওর প্রতি এতো দুর্বার আকর্ষণ বোধ করি না যে, সবকিছু ফেলে ওর কাছে ছুটে আসতে হবে। আমাদের ভালোবাসা আছে, কামনা হলে মিলন হবে। আমরা সুন্দর সময় কাটাবো। দুজনের খুব ভালো লাগবে, ব্যস এটুকুই তো! এটা নিয়ে এতো জোরাজুরি আর প্রাণ দিয়ে দেবার কী আছে!

কিন্তু না, মেয়েটা আমাকে কামনা করে। যেন আমি একটা পতঙ্গের মতো আগুনে ঝাপ দেই। যেমন ও ঝাপ দিয়েছে প্রেমে। ওর এই অতি ভালোবাসা মাঝে মাঝে আমাকে বিব্রত করে, মৃদূ বিরক্তিবোধ করি। ভালোবাসা নিয়ে এতো লেবু কচলানোর কি থাকতে পারে। মানুষের এই সব আধুনিক বোধ বিবেচনা থাকা প্রয়োজন। বাস্তবতা বোধ খুব জরুরি।

এখন মেয়েটা বলেছে আমার মার কবরে যাবে। আমার মার কাছে নালিশ করবে। হ্যাঁ আমার মার কবরটা আমার ভালোলাগার জায়গা। ওখানে আমি মাঝে মাঝেই যাই। কোনো কোনো সময় দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হই। কোনো কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতা থাকলে আমি মার কবরের পাশে দাঁড়াই তারপর আশ্চর্য সঠিক নির্দেশনা পেয়ে যাই। এ বিষয়গুলো আমি অর্চনাকে বলেছি। সে তাই যেতে চাচ্ছে আমার মায়ের কবরে। মৃত মানুষের কাছে জানাতে চাচ্ছে নালিশ। বিষয়টা খুবই উন্মত্ততার ও ছেলেমানুষীর তবু বিষয়টা আমার কৌতুক ও কৌতুহল সৃষ্টি করে।

আমি আবার একটু হেসে জিজ্ঞেস করি- হু, তো কী তোমার নালিশ?

আপনার মার কাছে আমি বলে আসবো আপনি আমাকে এভোয়েড করছেন। তিনি নিশ্চয়ই একটা কিছু করবেন।

তিনি কী করবেন?

তিনি নিশ্চয় একটা সমাধান দিবেন। আমাদের দুজনের মধ্যে যা হয়েছে তা বলবো, তারপর আপনার যা করার কথা আপনি তা করছেন না এসব বলবো, বলবো আপনি ফোন ধরেন না । দূরে দূরে থাকছেন।

আমি একটু দুষ্ট হাসি নিয়ে বলি আমাদের মধ্যে কী হয়েছে?

কী হয়েছে আপনি জানেন না?

আমাদের মধ্যে যা হয়েছে। তা একটা নারী আর একটা পুরুষের মধ্যে হওয়া খুব স্বাভাবিক। সব নারী পুরুষের মধ্যেই এটা হয়।

আপনি বলতে চাচ্ছেন এটা এমন যে, যার-তার সাথেই হয় ।

না না, তা বলবো কেন। পরষ্পরের মধ্যে ভালোবাসা থাকলেই এটা ঘটে। এটা দুটো নর-নারী কাছে আসলে ঘটে। তোমার আমার মধ্যেও তাই ঘটেছে।

কিন্তু এখন আপনি আমাকে আর পছন্দ করছেন না কেন?

আমি ওর গালে একটু হাত বুলিয়ে আদরের সাথে বলি- কে বললো তোমাকে পছন্দ করছি না। তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি।

আপনি আমার ফোন কেটে দেন। আমার কোনো কথা আপনি শুনেন না। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব। আমি আপনাকে আমার কাছে কাছে চাই নাহিদ। আমাদের সম্পর্কের একটা পরিণতি চাই।

আমি তো তোমাকে বলেছি আমি ভালোবাসায় বিশ্বাস করি। কোনো বন্ধনে বিশ্বাস করি না।

আপনি তো আমাকে বলেছিলেন সারাজীবন ভালেবাসবেন।

তা তো বাসবোই। ভালোবাসার সাথে বিয়ের তো কোনো সম্পর্ক নেই।

বিয়ের সম্পর্ক থাকবে না কেন? দুজন মানুষ ভালোবাসলে ঘর করতে চাইবে না? প্রেম কে আরো দৃঢ় করতে চাইবে না?

বিয়ে প্রেমকে দৃঢ় করে না নষ্ট করে দেয়। বিয়ে হলে প্রেম শুকিয়ে যায়।

ওর চোখ ছলছল করে- আমি তো আপনাকে ছাড়া আর কিছু বুঝতে চাই না।

মেয়েদের নিয়ে এই এক জ্বালা, ওদের চোখে সামান্যতেই পানি চলে আসে। আবেগে গদগদ হয়। ভালোবাসা মানেই আঁকড়ে ধরতে চায়। এই সব জঞ্জাল থেকে আমি মুক্ত থাকতে চাই। মুক্ত মনে ভালোবাসতে চাই। ভালোবাসা আর প্রেমে ডুবে থাকতে চাই । ভালোবাসার অপার আনন্দ ভোগ করতে চাই। এই সব মেয়েরা এটা বুঝে না। এই সংসার করার জন্য ঘ্যান ঘ্যান এগুলো আমার চরম বিরক্তির। অর্চনা ঠিকই বলেছে আমি বোধহয় আজকাল ওকে কিছুটা অপছন্দ করতে শুরু করেছি। তবে আমি কোনো মেয়েকেই কখনো খুব বেশি অপছন্দ করতে পারি না।

অর্চনার সাথে আমার সম্পর্কটা আমি ওই রকমই রাখতে চাই, একটা মিষ্টি সম্পর্ক থাকবে । যখন ভালো লাগবে দুজনে প্রেমের কথা বলবো, প্রেমকে উপভোগ করবো। দুজনের কথা হবে, গল্প হবে। কিন্তু চাইলেও কেন জানি এরকম হচ্ছে না। গত মাসে অর্চনার সাথে দেখা হয়নি। ব্যস্ততা যাচ্ছে। সময় পাচ্ছি না। নানাবিধ বিষয়ে জড়িয়ে আছি। আর রক্তে তীব্র টানও অনুভব করছি না। যাবো একসময় এরকম ভাবতে ভাবতেই ওর ফোন পাই।

আমি বনানী কবরস্থানে গিয়েছিলাম। আপনার মার কবরে গিয়েছি। গোলাপ দিয়ে এসেছি। কথা বলে এসেছি।

আমার মার কবরে গিয়েছো? কিভাবে চিনলে এটা আমার মার কবর? আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করি।

হ্যাঁ চিনেছি ।

আমি উত্তেজনায় শোয়া থেকে উঠে বসি- কীভাবে চিনলে?

কবরস্থানের একজন লোককে জিজ্ঞেস করলাম- হোসনে আরার কবর কোনটা? সে বললো কোন হোসনে আরা? আপনার শারীরিক বর্ণনা দিয়েছি। বলেছি আপনি একজন বিখ্যাত কবি নাহিদ রহমান। এইখানে মাঝে মাঝেই আসেন। একটা কবরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। হোসনে আরার কবর। সেই কবরটা কোনটা?

লোকটা বললো– আপা, কত মানুষ আইস্যা কত কবরে দাঁড়াইয়া থাকে, কেমনে কমু কোন কবর।

হোসনে আরা নামে কোনো কবর নেই?

নাম দেইখ্যা কবর পাইবেন? আইয়েন দেখি পাই নাহি।

লোকটা আমার পাশে পাশে এলো। তারপর সামনে এগিয়ে গেলাম। যেতেই থাকলাম যেতেই থাকলাম। দেখলাম অসংখ্য হোসনে আরা শুয়ে আছে। হোসনে আরা নামের কবর আর শেষ হয় না। কারো নাম হোসনে আরা জামান, হোসনে আরা বানু, হোসনে আরা খানম, অসংখ্য হোসনে আরার অসংখ্য নাম। যেতে যেতে সবগুলো হোসনে আরার কবরে একটা করে গোলাপ রেখে এসেছি। আর চিৎকার করে বলেছি নাহিদের মা হোসনে আরা, হোসনে আরা তুমি কোন কবরে শুয়ে আছো বলো, আমি তোমার কাছে নাহিদের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে এসেছি। আমি নিশ্চিত আপনার মা ঐ সব কবরের কোনো কোনো একটায় শুয়ে আছেন। তিনি আমার কথা শুনতে পেয়েছেন। তিনি আমার জন্য কিছু একটা কবরেন।

আমি ফোন হাতে নিশ্চুপ হয়ে থাকি। নিশ্চিত জানি সে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ আমার মায়ের কবরে কোনো নেমপ্লেটই নেই!

এই বিভাগে আরো পড়ুন

কয়েক ফোঁটা স্মৃতির মধু

কবিতা প্রসঙ্গে নানা অনুষঙ্গ খুব স্মৃতিকাতর করে তোলে আজকাল। কনটেক্সট ছাড়া যেমন টেক্সট হয় না, অনুষঙ্গ ছাড়াও প্রসঙ্গ তেমনি গুরুত্ব হারায়। মাঝে মধ্যে ভাবি স্মৃতিই

দেদীপ্যমান কবি ও কবিতা

ফরিদা ইয়াসমিন সুমি কবিতা ও প্রেম তোমার হৃদকম্পনের অনুবাদ করতে গিয়ে ক্রমান্বয়ে অণুগল্প, ছোটগল্প, বড়গল্প হয়ে উপন্যাস হয়ে গেছে। সম্পূর্ণ করবার পরে নিবিড় বিস্ময়ে লক্ষ্য

মহাকালের কবি ও কবিতা

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল মায়ের মানিওর্ডার চাঁদও মায়ের মতন আমাদের সাথে সাথে থাকে, জোছনা এবং স্নেহাদর সমান্তরাল। মন্ট্রিয়লে হোটেল ম্যারিয়টে ভিসাকার্ড হারানোর সাথে সাথে পেয়ে যাই

যুদ্ধ শেষ যুদ্ধ আছে

যুদ্ধ কি শেষ? এরূপ প্রশ্নে পাল্টা প্রশ্ন আসবে এ আবার কেমন কথা? কথা যাই হোক, তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়াও যায় না! আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, ভৌগলিক