একজন কবি খোলা চোখে তার ভাবনার জগতকে কীভাবে চিত্রায়ন করেন তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে একজন পাঠক অবলোকন করতে চান। জীবানানন্দ দাশকে আমরা নির্জনতার কবি হিসেবে জানি। তাঁর কবিতার আবেদন সর্বজনীন। বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ।
‘আমাদের আধুনিক কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সবচেয়ে নির্জন, সবচেয়ে স্বতন্ত্র। বাংলা কাব্যের প্রধান ঐতিহ্য থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন, এবং গেলো দশ বছরে যে-সব আন্দোলনের ভাঙা-গড়া আমাদের কাব্যজগতে চলেছে, তাতেও কোনো অংশ তিনি গ্রহণ করেননি। তিনি কবিতা লেখেন, এবং কবিতা ছাড়া আর-কিছু লেখেন না; তার চেয়ে তিনি স্বভাব-লাজুক ও মফস্বলবাসী; এইসব কারণে আমাদের সাহিত্যিক রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদীপ থেকে তিনি সম্প্রতি যেন খানিকটা দূরে সরে গিয়েছেন। আধুনিক বাংলা কাব্যের অনেক আলোচনা আমার চোখে পড়েছে যাতে জীবনানন্দ দাশের উল্লেখমাত্র নেই। অথচ তাঁকে বাদ দিয়ে ১৯৩০ পরবর্তী বাংলা কাব্যের কোনো সম্পূর্ণ আলোচনা হতেই পারে না। কেননা এই সময়কার তিনি একজন প্রধান কবিকর্মী, আমাদের পরিপূর্ণ অভিনিবেশ তাঁর প্রাপ্য।’ (বুদ্ধদেব বসু, ‘কবিতা’, আশ্বিন ১৩৪৯)
জীবনানন্দ দাশ আমাদের কাব্যভুবনে অতিপ্রিয় একটি নাম। যাঁর কবিতা পাঠের মধ্যে দিয়ে আমরা বেড়ে উঠেছি। জীবনানন্দ দাশ বাংলার প্রকৃতি ও মানুষকে সমানভাবে তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন। কেমন ছিলেন জীবনানন্দ দাশ? এরকম রহস্যময় প্রশ্নের মুখোমুখি আমি নিজেও কখনো কখনো থিতু হয়ে বসি। এক ধরনের বিষাদ ও রহস্যময়তা আমার ভিতরেও ভর করে থাকে। তাঁর কবিতার বহুসংখ্যক পাঠকই মনে করেন জীবনানন্দ দাশ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। তাঁর কাব্য জীবনে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্থান ছিল বটে। বুদ্ধদেব বসুকে লেখা জীবনানন্দ দাশের উদ্ধৃত অংশটি এখানে পাঠকের জন্য তুলে দেয়া হলো :
‘কলকাতার অলিগলি মানুষের শ্বাসরোধ করে বটে, কিন্তু কলকাতার ব্যবহারিক জীবনে একটা প্রান্তরের মতো মুক্তি পাওয়া যায়; এখন যখন জীবনে কর্মবহুলতার ঢের প্রয়োজন, কলকাতার এই স্বচ্ছন্দ পটভূমির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা চলে না আর’।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা আমাদের ভাবনার জগতকে প্রবলভাবে সম্মোহিত করে রাখে। তাঁর সমসাময়িক কবিদের থেকে তাঁর কাব্যরুচি অনেকটাই আলাদা। কবিতার নান্দনিক বিবেচনায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা একটি আলাদা মাত্রা ও বোধের সমীকরণ তৈরি করে :
হেমন্ত ফুরায়ে গেছে পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে;/এ-রকম অনেক হেমন্ত ফুরায়েছে/সময়ের কুয়াশায়;/মাঠের ফসলগুলো বার-বার ঘরে/তোলা হ’তে গিয়ে তুব সমুদ্রের পারের বন্দরে/পরিচ্ছন্নভাবে চ’লে গেছে।/মৃত্তিকার ওই দিক আকাশের মুখোমুখি যেন শাদা মেঘের প্রতিভা/এই দিকে ঋণ, রক্ত, লোকসান, ইতর, ঘাতক;/কিছু নেই- তবুও অপেক্ষাতুর;/হৃদয়স্পন্দন আছে-তাই অহরহ/বিপদের দিকে অগ্রসর;/পাতালের মতো দেশ পিছে ফেলে রেখে/নরকের মতন শহরে/কিছু চায়;/কী যে চায়।
তিরিশের দশকের বাংলা কবিতার যে পটভূমি নির্মিত হয়েছিল তা আজ অবধি একজন কবিতাপাঠককে জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়; তখন বাংলার কবিতার ক্ষেত্রে যে আন্দোলন মানুষের মনে বাসা বেঁধেছিল, সেখানে মানুষের মনের সংঘাতটিও তীব্র হয়ে ওঠে। আধুনিক নাগরিক জীবনের সংঘাতের সাথে একজন কবির ভাবনার জগত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন প্রকৃত কবি মানুষ ও প্রকৃতির কাছে লগ্ন হয়ে থাকতে চান। জীবনানন্দ দাশের বেড়ে উঠার পারিপার্শ্বিক চিত্র ঘাত-প্রতিঘাত, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সামাজিক জীবনের টানাপোড়েন তাঁকে বিধ্বস্ত ও বিমর্ষ করেছে অহর্নিশ। শুদ্ধ কল্পনা ও অভিজ্ঞতার জারিত রূপ একজন কবিকেও সমানভাবে সংকট এবং সমাধানের দিকে ধাবিত করে। উৎকৃষ্ট চিত্তের সাথে মননের যে বৈভব তা আধুনিক কবিতার রূপ ও রসের সাথে কবিকেও জারিত করে। প্রকৃতির সাথে জীবনানন্দ দাশ লগ্ন হয়ে থাকতেন। তাঁর নিঃসঙ্গতা ভাবনার জগতের সাথে দীপ্তিময় হয়ে ওঠে :
পৃথিবীতে তামাশার সুর ক্রমে পরিচ্ছন্ন হ’য়ে
জন্ম নেবে একদিন। আমোদ গভীর হ’লে সব
বিভিন্ন মানুষ মিলে মিশে গিয়ে যে-কোনো আকাশে
মনে হবে পরস্পরের প্রিয়প্রতিষ্ঠ মানব।
এই সব বোধ হয় আজ এই ভোরের আলোর পথে এসে
……………………………………………….
এদের স্বজন, বোন, বাপ-মা ও ভাই, ট্যাঁক, ধর্ম মরেছে;
তবুও উচ্চস্বরে হেসে ওঠে অফুরন্ত রৌদ্রের তিমিরে।
[সমুদ্রতীরে]
কীভাবে পৃথিবীতে জীবন সৃষ্টি হয়েছিল তাও আমাদের কাছে কবিতার মতই রহস্যময়। বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানের সাহায্যে আমরা জগত ও জীবনের উৎপত্তি এবং বিকাশ অবলোকন করতে পারি। বিশেষ ইচ্ছার কাছে ধারণা মহাজগতের কাছে সম্পর্তিত হতে থাকে। একজন সাধারণ মানুষও তার সময়কে ধারণ করতে চায়। ‘বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিস্টপূর্ব) বিশ্বাস করতেন যে, জড় পদার্থ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবের উৎপত্তি হয়েছে।’ আমাদের ভাবনার ভিতরে জীবন ও জগত সম্পর্কে রহস্যের জাল চোখের ওপর ঝুলে থাকে। এ থেকে মুক্তি পেতে আমরা কবিতায় মগ্ন হয়ে থাকতে চাই। একজন কবির যাপিতজীবন খুব কাছ থেকে দেখলে একজন সাধারণ মানুষের মতই মনে হতে পারে। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে যা দেখা যায় তা সবটুকু অন্যরকমও হতে পারে– হাজার বছর ধরে মানুষ তার স্বপ্ন ও বিষাদকে লালন করে থাকে।
‘বনলতা সেন’ কবিতায় জীবনানন্দ দাশ হাজার বছরের স্বপ্নকে লালন করতে চেয়েছেন :
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে।
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার আশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘বনলতা সেন’ কবিতার মধ্যে জীবন, জগত ও নক্ষত্রের মধ্যে দূরত্ব নির্ণয় করতে চেয়েছেন। ভাঙতে চেয়েছেন কল্পনার জগত। অসম্ভবকে চেয়েছেন সম্ভব করতে অতীতকে টেনে এনে সামনে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। ছিন্ন করেছেন সব রহস্যের জাল। শূন্যতাকে জয় করতে চেয়েছেন। তাঁর কবিতায় বিরামহীনভাবে পৃথিবীর তাবৎ নিস্বর্গরাজি ভাবের প্রতীক হয়ে বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর ভর করে তাঁর কবিতার ভিতর পাখা মেলে দিয়েছে। তাঁর লক্ষ্য অব্যর্থ।
আমার এ গান/কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে-/আজ রাত্রে আমার আহ্বান/ভেসে যাবে পথের বাতাসে,/তবুও হৃদয়ে গান আসে।/ডাকিবার ভাষা/তবুও ভুলি না আমি-/তবু ভালোবাসা
(সহজ)
আধুনিক কবিতার প্রথম শর্ত হলো জ্ঞান ও বুদ্ধির চর্চা। একজন কবি তাঁর জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়ে সময় ও কালকে ধারণ করতে চায়। কবিতায় তুলে আনতে চান স্বপ্ন, বিষাদ, অবক্ষয়, যন্ত্রণা এবং অতীত-ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সময়কে। জীবনকে জীবনের সঙ্গে রেখেই তিনি হেঁটেছেন বহুদূর পর্যন্ত। মৃত্যুর পরও তিনি শঙ্খচিল ও শালিখের বেশে পৃথিবীতে ফিরে আসতে চেয়েছেন :
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায়/হয়তো মানুষ না- হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/হয়তো ভোরের কাক হ’য়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
কখনো কখনো একজন কবিও তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে এবং জীবনবোধের মুখোমুখি তাঁকে দাঁড়াতে হয়। একজন কবির জীবনেও দুর্যোগের ঘনঘটা বেঁজে উঠতে পারে। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন নিভৃতচারী কবি। তাঁর সময়ের কবিরা তাঁকে যথেষ্ঠ অবজ্ঞার চোখে দেখতেন। তাঁর কাব্য প্রতিভা নিয়েও তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন। তিরিশের দশকের বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এই চারজন কবি জীবনানন্দ দাশকে আধুনিক কবি হিসেবে স্বীকার করতে চাইতেন না। সে সময় বুদ্ধদেব বসু এবং বিষ্ণু দে আধুনিক কবিদের মধ্যে ছিলেন জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ। কেবল জীবনানন্দ দাশই নয় পাশাপাশি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর কবিতা নিয়েও বিতর্ক ছিল। কবি বুদ্ধদেব বসু জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে বলেন :
‘আজ নতুন করে স্মরণ করা প্রয়োজন যে জীবনানন্দ, তাঁর কবিজীবনের আরম্ভ থেকে মধ্যভাগ পর্যন্ত, অসূয়াপন্ন নিন্দার দ্বারা এমনভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন যে তারই জন্য কোনো এক সময়ে তাঁর জীবিকার ক্ষেত্রেও বিঘ্ন ঘটেছিল। এ কথাটা এখন আর অপ্রকাশ্য নেই যে ‘পরিচয়ে’ প্রকাশের পরে ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির সম্বন্ধে ‘অশ্লীলতা’র নির্বোধ এবং দুর্বোধ্য অভিযোগ এমনভাবে রাষ্ট্র হয়েছিল যে কলকাতার কোনো এক কলেজের শুচিবায়ুগ্রস্ত অধ্যক্ষ তাঁকে অধ্যাপনা থেকে অপসারিত করে দেন। অবশ্য প্রতিভার গতি কোনো বৈরিতার দ্বারাই রুদ্ধ হতে পারে না এবং পৃথিবীর কোনো জন কীটস অথবা জীবনানন্দ কখনো নিন্দার ঘায়ে মূর্ছা যান না– শুধু নিন্দুকেরাই চিহ্নিত হয়ে থাকে মূঢ়তার, ক্ষুদ্রতার উদাহরণস্বরূপ।’
জীবনানন্দ দাশ কবিতার দিগন্তকে উপমার মাধ্যমে পাঠকের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কবিতায় মানুষ, দেশ, মাটি, সমুদ্র, পাহাড় এবং তাঁর সময়ের তাবৎ অসামঞ্জস্য বিষয়সমূহ মূর্ত হয়ে উঠেছে :
কোনো হ্রদে
কোথাও নদীর ঢেউয়ে
পরস্পরের সাথে দু-দন্ড জলের মতো মিশে
সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে
আমাদের জীবনের আলোড়ন-
হয়তো বা জীবনকে শিখে নিতে চেয়েছিলো।
[তিমিরহননের গান]
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এক নিজস্ব আঙ্গিক রয়েছে যা অসামান্য মৌলিক। পাঠকের রুচিবোধকে তিনি আরও একটু উস্কে দেন- কবিতা পাঠে মনযোগী হবার জন্য। দ্বিধাবিভক্ত সমাজে মানুষের মনের জগতকে তিনি কবিতার মাধ্যমে জয় করতে চাইতেন, ধারণ করতে চাইতেন পাঠকের আবেগকে। আমার প্রিয় কবি অবশ্যই জীবনানন্দ দাশ। আমি যখন তাঁর কবিতা পাঠ করি তখন আমার ভাবনার ভেতরে একটি আলাদা জগত তৈরী হতে থাকে-ভাষায়-ব্যঞ্জনায়-চিত্রকল্পনায় বলবেন বলুন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা আত্মগত ও সুররিয়্যালিস্ট। জীবনানন্দ বাংলা কাব্যে অনন্য :
যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে- দূর কুয়াশায়
চ’লে যাব, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর
ভিক্ষা ক’রে লয়ে যাবে;– সেদিন দু’দন্ড এই বাংলার তীর–
এই নীল বাংলার তীরে শুয়ে একা একা কি ভাবিব, হায়;–
সেদিন র’বেনা কোনো ক্ষোভ মনে- এই সোঁদা ঘাসের ধুলায়
জীবন যে কাটিয়াছে বাংলায়– চারিদিকে বাঙালির ভিড়
বহুদিন কীর্তন ভাসান গান– রূপকথা যাত্রা পাঁচালীর
নরম নিবিড় ছন্দে যারা আজো শ্রাবণের জীবন গোঙায়,
আমারে দিয়েছে তৃপ্তি।…
জীবনানন্দ দাশ কবিতার মধ্যে ইতিহাস ও পুরাণের ব্যবহার করতে গিয়ে গভীরভাবে অবলোকন করেছেন প্রেম ও প্রকৃতি। বাংলার রূপকে তিনি অঙ্কন করেছেন জলসিঁড়ি নদী থেকে বাঙালির মানসলোকে চাঁদ, বেহুলার লহনার মধুর জগত, প্রাচীন সভ্যতার আলো, চেতনার ও স্মৃতির বৈভব এবং বর্তমান অতীতে যোগসূত্র অনুষঙ্গ হিসেবে তাঁর কবিতায় রূপায়ণ ঘটেছে :
১.
আবার পেতাম যদি সে শরীর– সে জীবন– তাহলে প্রণয় প্রেম সত্য হতো;
আজ তা বিস্ময়।
আজ তা বিস্ময় শুধু– শুধু স্মৃতি শুধু ভুল–হয়তো কর্তব্য বিহ্বলতা :
সাত-রাত সাত-দিন পৃথিবীতে কেবলি ভেবেছি এই কথা।
[বৈতরণী]
২.
‘সেই জল-মেয়েদের স্তন
ঠান্ডা-শাদা-বরফের কুচির মতন।’
রূপক ও প্রতীকের বিচ্ছুরিত আলো জীবনানন্দ দাশের কবিতায় প্রগাঢ়ভাবে পাঠকের ভাবনাকে মোহমুগ্ধ করেছে। আজ অবধি জীবনানন্দ দাশের কবিতার আবেদন সর্বজনীন ও বহুল পঠিত। নির্জনতার কবি হিসেবে তিনি পাঠকখ্যাত। ‘বড় বিলম্বে তার সূচনা, আর অবিলম্বে সমাপ্তি’।
ক. ‘তাঁর কবিতার সঙ্গেই আগে আমার পরিচয়। রবীন্দ্রোত্তর যুগে তাঁকে মনে হয় একমাত্র কবি, যাঁর নিজস্ব দীপ্তি আছে। সমসাময়িক অন্যান্য কবিরা নানা পরীক্ষা নিরীক্ষায় যতই ব্যাপৃত হোন না কেন, রবীন্দ্র-বলয়েই ছিল তাঁদের অবস্থান। জীবনানন্দকে তখনও আমি চিনতাম না। শুধু তাঁর কবিতা পড়ে মনে হত, এই এক কবি যাঁর কাব্যভাষা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং গভীর অনুভূতির প্রকাশরূপ অন্য সবার থেকে পৃথক। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “ঝরা পালক” পড়লে অবশ্য মোহিতলাল ও নজরুলের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, তুব আরও খুটিয়ে দেখলে সেখানে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আভাসও মেলে। পর্বগামীদের পথ থেকে অচিরেই ভিন্নমুখী তাঁর আত্মিক পরিত্রাণ।’ (কবি অরুণ মিত্র)
অগ্রজদের তুলনায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা অনেক বেশি তরুণদেরকে আকৃষ্ট করে। একজন সমঝদার পাঠক তিরিশের দশকের অন্যান্য কবিদের চাইতে জীবনানন্দ দাশের কবিতা অধিকতরভাবে গ্রহণ করে থাকে। তাঁর কবিতা আমাদের ভাবনার জগতকে উন্মচিত করে। আলো-অন্ধকার, অনুভূতি-উপলদ্ধি, জীবন ও মৃত্যুকে বিস্ময়কভাবে জীবনানন্দ দাশ উপলদ্ধি করেছেন–
‘বাংলার ঘাসে
গভীর ঘাসের গুচ্ছে ঘুমায়ে রয়েছি আমি– নক্ষত্র নড়িছে
আকাশের থেকে দূর– আরো দূর– আরো দূর নির্জন আকাশে
বাংলার–‘
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় জীবন ও জগত সম্পর্কিত ইতিবাচক ব্যাখ্যা যা আমাদের অস্তিত্বকে ক্লান্তিহীন করে। জীবনানন্দ কবিদের কবি। আমি তাঁর কবিতার অনুরাগী পাঠক। তাঁর কবিতা বহুদূর পর্যন্ত আমাদের নিয়ে যায়। জগত সংসারের তাবৎ ঐশ্বর্য তাঁর কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায়। ব্যক্তি জীবনে জীবনানন্দ দাশ ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণার স্বীকার হয়েছেন, যার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো :
‘কবি জীবনানন্দের কোনো ঘর ছিল না। মানুষ জীবনানন্দের ছিল কি? সম্ভবত না। তাঁর আশ্রয় ছিল। কিন্তু ঘর ছিল না। আমরা জানি জীবনের শেষ বেলায় একটা ঘরের জন্য উথাল-পাথাল অন্বেষণে মেতেছিলেন তিনি। প্রিয় পরিজনদের কাছে এসময়ে তাঁর সবচেয়ে জরুরি সমাচার ছিল, একটা ঘর দেখে দিতে পারো? আজীবন মনের বাসনার রঙে রাঙানো কোনো ঘরে বাস করা হয়নি যেন। যেন একটা একান্ত-আপন ঘরের অভাবে কালি-ঝুলি মাখা রয়ে গেছে তাঁর ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার ডালপালাগুলো।’ (পূর্ণেন্দু পত্রী)
আমৃত্যু জীবনানন্দ দাশের কবিতা পাঠ করতে চাই। একজন সফল কবি সব সময়ই নির্মোহ থাকেন। তাঁর পারিপার্শ্বিক বিষাদ, পরশ্রীকাতরতা এবং জীবনের সব আকাঙ্ক্ষাকে তিনি জয় করতে চেয়েছিলেন :
কত যে ঘুমিয়ে রব বস্তির পাশে/কত যে চমকে জেগে উঠব বাতাসে/হিজল জামের বনে থেমেছে স্টেশনে বুঝি রাত্রি নিশুতির বনলতা সেন