কবিতা প্রসঙ্গে নানা অনুষঙ্গ খুব স্মৃতিকাতর করে তোলে আজকাল। কনটেক্সট ছাড়া যেমন টেক্সট হয় না, অনুষঙ্গ ছাড়াও প্রসঙ্গ তেমনি গুরুত্ব হারায়। মাঝে মধ্যে ভাবি স্মৃতিই বরং কাতর হয়ে আছে। আমার ভাবনার ফাঁকফোঁকরে ঢুকে পড়বার জন্য ওঁৎ পেতে আছে সারাক্ষণ। অবসরের আনন্দ হয়ে ডানা মেলছে বারবার। আমার মন চায় পাঠকও সেই ডানায় ভর করুক। যদিও আমি জানি না, আনন্দ এতটা সংক্রামক হয় কি না। তবে আমার কবিতাযাপনের উত্তাল সময়, উন্মাদনা এবং উচ্ছ্বাসের বহুলাংশ উঠে আসতে পারে এ লেখায়। আর তা যদি পাঠককে অন্তত তৃপ্তি দেয়, সেটা বেশ উপাদেয় একটা ব্যাপার হবে আমার জন্য। ‘চিন্তাসূত্র’ এবং ‘লোক’-এ কবিতার জন্মবৃত্তান্ত বলতে গিয়ে কিছু টুকরো স্মৃতির কথা আলোচনা করেছি। সেসব এখানেও জুড়ে দেবো আজ। আর এই স্মৃতির রেখা বহুদূর টেনে নেবো বলে এ লেখাই শেষ নয়। অন্য কোনো পরিসরে হয়তো আরো কথা জোড়া লাগবে। খুশির আবেশে ছড়িয়ে পড়বে স্মৃতির সংরাগ। বেদনাও বিচ্ছুরিত হতে পারে। সেই স্মৃতি সংক্রমণের প্রাথমিক প্রচেষ্টা হিসেবে এই লেখা গৃহীত হবে, এটাই আমার কাম্য। অনলাইন ওয়েবম্যাগ ‘চিন্তাসূত্র’ একবার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলো। কবিতা লেখার শুরুর সময়টা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করেছিলাম। কয়েক ফোঁটা স্মৃতির মধু ঢেলে দিতে সেই অংশটুকু প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। সামান্য কাটছাঁট করে তুলে ধরছি :
আগে নাটক লিখতাম। স্কুলে আমার লেখা নাটক হয়েছে। ১৯৯৭ সালে ঢাকার গাইড হাউজ মঞ্চেও ‘অচিনপুরের অগ্নিগাথা’ নামে আমার একটা নাটক মঞ্চস্থ হয়। নিজেও অভিনয় করেছি ওই নাটকে। পরে আর ওই নাট্যদল টিকে থাকেনি। আমিও প্রেমটেমে জড়িয়ে বিয়েশাদি করে ফেললাম। নাটকে স্থিত হতে পারলাম না। কবিতা তো সেই স্কুল জীবন থেকেই লিখতাম। তবে ১৯৯৩ বা ৯৪ সালের দিকে জীবনানন্দ পাঠ করে বুঁদ হয়ে থাকতাম। পড়লাম আল মাহমুদ ও জয় গোস্বামী। শামসুর রাহমান তখন অনেক সরব। এমনিতেই কানে আসে। ফলে কবিতার আবহ আমাকে দারুণ তাড়িত করছিলো। কিন্তু নাট্যকার হওয়ার বাসনায় ওই দিকে নজর দিতে পারি নাই। কিন্তু ২০০০ বা ২০০১ সালের দিকে রাতুল আহমেদ সম্পাদিত ‘লাস্ট বেঞ্চ’ নামক লিটলম্যাগকে কেন্দ্র করে কবিতার তাড়না আবার জেগে ওঠে। সেই এক উত্তাল সময়! সিদ্ধি খাওয়া ও সিদ্ধি অর্জন এক সঙ্গেই চলছিলো। সাঈফ ইবনে রফিক তার ‘কাঁটাতার’-এ আমার ‘পরম্পরা’ কবিতাটা ছাপে। সেই থেকে কবিতায় ঝাপিয়ে পড়লাম। বিয়ের আগে হয়তো প্রেমের স্বার্থে কবিতা লিখেছি। তবে বিয়ের পর সত্যিকার অর্থেই কবিতায় নামলাম। কবিতা আসলে পরিকল্পনার বিষয় না। কল্পনার বিষয়। কবি হওয়াটাও ঠিক তাই। ওই সময়টাতে আমি ‘মেইনরোড’ সম্পাদনা করি। কয়েকটা সংখ্যা করেছিলাম মাত্র। ‘মেইনরোড’ ও সাঈফ ইবনে রফিকের সুবাদে কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের সঙ্গে পরিচয় হয়। এই অগ্রজ কবি আমাকে দারুণ প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই ভালোবাসাও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি আজ। ‘মেইনরোড’-এর সম্পাদকীয় তিনি শামসুর রাহমানকে পড়ে শুনিয়েছিলেন ফোনালাপে। শাহরিয়ার ভাইয়ের কাছে শুনেছি শামসুর রাহমান বেশ পছন্দ করেছিলেন ওই সম্পাদকীয়। পরে শাহরিয়ার ভাইয়ের পরামর্শেই শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমরা দেখাও করি। তার সঙ্গে দেখা হওয়া এবং নাতিদীর্ঘ আলাপের সেই স্মৃতি আমার কবি-সত্তায় আজও ভালোলাগার অনুষঙ্গ হয়ে আছে। তার সৌম্য চেহারায় বয়সজনিত বলিরেখা তারুণ্যকে ম্লান করতে পারে নি বলে মনে হয়েছে সেদিন। শুধু কথা বলছিলেন থেমে থেমে। ভাঙা ভাঙা শব্দের তোড়ে এই বর্ষীয়ান কবির বয়স টের পাচ্ছিলাম আমরা।
শামসুর রাহমানের হাতে ‘মেইনরোড’ তুলে দেবার আগে লিখে দিয়েছিলাম : কবিবর শামসুর রাহমানকে কাজী নাসির মামুন। ‘শ্রদ্ধেয় কবিবর’ও লিখে থাকতে পারি। পুরো মনে নেই। এতে তিনি উষ্মা প্রকাশ করছিলেন। উষ্মার মর্মার্থ হিসেবে তিনি যা বললেন তা মোটামুটি এরকম : এতদিন কী লিখলাম যদি শামসুর রাহমানের নামের আগে ‘কবিবর’ লিখে চিনিয়ে দিতে হয়? আসলে ‘মেইনরোড’ তো আমি তাকেই দিচ্ছি। ফলে চেনানোর প্রসঙ্গটা অবান্তর। বরং কবি-পরিচয়কে মুখ্য ধরে আমি সম্বোধন করেছি। তাকে বড় করতেই এই সম্বোধন। সেটা তিনি বুঝতে পারেন নি। কিন্তু তার ওই টসটসে অহংবোধ এতটা কবিসুলভ যে আমি খুবই ইতিবাচকভাবে নিয়েছি কথাটা। অনেক বলে কয়েও ‘তুমি’ বলাতে পারি নি। আমাদের তিনি ‘আপনি’ বলেছেন। ব্যক্তিত্বের এই দৃঢ়তা ভালো লেগেছে আমার। তখন কবির স্মৃতি শক্তি দুর্বল। শরীরও খুব সুস্থ নয়। ফলে আলাপে অনেক চেষ্টা করেও এ্যালেন গিন্সবার্গের নামটা স্মরণ করতে পারলেন না। আমরা মনে করিয়ে দিলাম। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা অবশ্য বলেছেন :
এখন তো অনেক কবি। অনেক কবি থাকার সুবিধা হলো নানা রকম কবিতার স্বাদ পাওয়া যায়। অসুবিধাও আছে। ভালোদের থেকে আগাছাদের পৃথক করা যায় না।
আমার অনেক লেখায় ও সাক্ষাৎকারে তার এই কথার উল্লেখ করেছি।
‘কবিতায় ঝাপিয়ে পড়া’র সেই উত্তাল সময়টার আগেই কাব্যের তাড়না আমাকে বিহ্বল করে দিত। তখন মনে হতো আমার নাট্যতাড়নার ওপর কাব্যতাড়নার এই অন্তর্ঘাৎ প্রতিরোধের কোনো ক্ষমতা আমার নাই। অনার্সের ক্লাসমেট তাপস সরকার। বাসায় ওর ডাক নাম ছিলো তপু। কাঁঠালবাগানে ওর বাসা। শহীদবাগ কিংবা কাজীপাড়া, যখন যেখানে ম্যাস নিয়েছি ও চলে আসতো আড্ডা দিতে। ওর বাসায় আমিও যেতাম। খুব মেধাবী ছিলো। সুনীল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু ব্যাপক পাঠ করেছে সে। আবুল বাশারের ‘অগ্নি বলাকা’ একবার উপহার দিলো আমাকে। নিজের টিউশনির টাকায় একবার একটা শার্টও দিলো কিনে। আমার সাহিত্যপ্রীতি কিংবা কাব্যপ্রেম অথবা নাট্যতাড়না কোন্ ব্যাপারটা তাকে মোহিত করেছিলো জানি না। কিন্তু আমাকে নিয়ে মুগ্ধতার কোনো ব্যাপার হয়তো ছিলো। তাই সম্পর্কের মধ্যেও সেই উচ্ছ্বাসকে সে ঢেলে দিয়েছে। কবিতা-কবিতা করে একাডেমিক পাঠে খুব মনোযোগ দিতে পারি নি আমি। প্রথম টিউটোরিয়ালে কত নম্বর পেলাম না পেলাম, এ নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা ছিলো না। ক্লাসে গিয়ে দেখি ‘তাপস তাপস’ রব উঠেছে বন্ধুদের মধ্যে। ও প্রথম হয়েছে। নিজের নম্বর দেখতে ওই প্রথম ব্যগ্র হয়ে উঠলাম। দেখলাম তাপসের চেয়ে আমি এক নম্বর বেশি পেয়েছি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের রব আস্তে আস্তে আমার দিকে ঝুঁকতে থাকলো। আমিও পাঠে মনোযোগ দিলাম। সেই থেকে তাপস আরও ঘনিষ্ঠ হলো আমার সঙ্গে। ওর মনস্তত্ত্বে জোরালে মেধাপ্রীতির একটা ব্যাপার ছিলো। আমার ওই সামন্য নম্বর বেশি প্রাপ্তিতে মেধার বিশেষ কোনো স্বাক্ষর যদিও ছিলো না। তাপসের মেধা আরও প্রখর। তার সাহিত্যচেতনাও ফেলনা নয়। এমন শাণিত জীবনবোধসম্পন্ন বন্ধু খুব কমই ছিলো আমার। প্রচুর সিগারেট খেতো। তখন আমিও চেইন স্মোকার। ‘গোল্ডলিফ’ প্রিয় ব্র্যান্ড। পরে কিছুদিন ‘ফাইভ ফিফটি ফাইভ’। একবার ম্যাসের সামনের চৌহদ্দিতে একটা বৃত্তাকার জায়গায় সারা রাত সিগারেট খেয়ে আর আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিলাম আমরা। বলতে গেলে প্রায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। ঘটনাটা কাজীপাড়ায়। মন ও মননে কবিতার আবেশ না থাকলে রাতভর এই আড্ডার আগ্রহ ধরে রাখা সম্ভব হতো না। কত বিচিত্র বিষয় আমরা আলাপ করেছি! কবিতা, উপন্যাস, রাজনীতি, নারী পুরুষের সম্পর্ক, যৌনতা, প্রেমসহ স্মরণের ডাঙায় যা এসে ঠেকতো সব নিয়ে তুমুল তর্কের এমন এক দার্শনিক ভিত্তি তৈরি হতো যার রেশ গড়িয়ে পড়তো পরবর্তী আড্ডাগুলোয়। ফলে আরব্য রজনীর গল্পের মতো আগত আড্ডার জমজমাট আবহ কল্পনা করে নিজেরা বিচ্ছিন্ন হতাম। আমার মননের পরিপক্কতায় এইসব আড্ডার অবদান অস্বীকার করবার উপায় নেই। ছোট বোনের বিয়েতে এলো তাপস। আবার রাতভর আড্ডা। কোনো এক প্রসঙ্গে বললো- দেখ নাসির, প্রেমে কোনো সাক্ষীসাবুদ লাগে না। যোগ্যতার প্রমাণাদি লাগে না। বিয়েতে সামাজিক প্রমাণপত্র লাগে। জোরালো সাক্ষী লাগে। হয়তো জানতে চেয়েছে আমরা দেখে শুনে বিয়ে দিচ্ছি কি না। সামাজিক বহু ব্যাপারে তার বোধ বিবেচনা বেশ চমকপ্রদ ছিলো। আরো চমকপ্রদ ছিলো তার মিথ্যা বলার শিল্পিত আঙ্গিক। গাল-গল্পে কখনোই সে গালি ব্যবহার করতো না। পরিশীলিত কথার মধ্যে কিছু কিছু মিথ্যা গল্পের মোহনতা দিয়ে আমাকেও সে মুগ্ধ করতো। নিজের বলা দার্শনিক বাণীর স্বপক্ষে গল্পগুলো তৈরি করতো সে। ফলে অকল্যাণকর ঠেকতো না। বরং মিথ্যার সৌন্দর্যে যে-ব্যাপ্ত চরাচর জেগে উঠতো দর্শনের, তাতে বিচরণ করতে ভালো লাগতো আমার। তাই ওসব শোনার জন্য আমি প্রসঙ্গ উসকে দিতাম। নিজের দার্শনিক বোধগুলো যাচাই করতাম ওর গল্পের পাটাতনে। একটা মেকি ব্যক্তিত্বের দেয়াল থাকতো ওর চারপাশে। সবাই প্রশ্রয় পেতো না তাই। অথচ ভিতরে ভিতরে সে ছিলো পলকা, ভঙুর। ওই মেকীত্ব এতটাই প্রকৃতিপ্রদত্ত বলে ধারণা হতো যে, ওটা ছাড়া ওকে ভালো লাগবার সম্ভাবনা ছিলো না। আমাদের বন্ধুত্বও জমতো কি না, সন্দেহ। আমার কথার মধ্যে সতস্ফূর্তভাবে যে স্ল্যাং চলে আসতো, কিছুটা অপরিশীলিত বকাঝকা, তা সে অবলীলায় মেনে নিতো। তাপসের মধ্যে কখনো হিন্দুত্ব চাড়া দিয়ে উঠে নাই। সাম্প্রদায়িকতা সামান্যও দেখি নাই। গরু খেতো নির্দ্বিধায়। মাঝে মধ্যে বলতো ও মাথায় টুপি পড়ে। মসজিদে যায়। আমি খুব বিশ্বাস পেতাম না। ও হাসতো। আমিও হেসে উড়িয়ে দিতাম। ধর্মান্তরিত হওয়ার কোনো ব্যাপার যে ঘটেনি, সে বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম আমি। বেশ পরে জানতে পারি আমাদের ক্লাসমেট মিহিরের সঙ্গে ওর প্রেম। মুসলমান মেয়ে মিহির ছিলো আল্ট্রা মডার্ন। নিজ ধর্মের প্রতি বিশেষ কোনো প্রীতিও লক্ষ্য করিনি মিহিরের মধ্যে। বরং তখনকার পরিবেশে আমরা তাকে ‘উগ্র মেয়ে’ হিসেবেই জেনেছি। একবার এক ইয়াং স্যারের সঙ্গে রিক্সায় চড়ে অবলীলায় হাসতে হাসতে চলে যেতে দেখলাম ওকে । আবার স্বামী-স্ত্রীর মতো একাট্টা হয়ে চলতো ফিরতো তাপস ও মিহির। এতো মিল মোহাব্বত যে, সবারই চোখে পড়তো। প্রেম সম্পর্কই বুঝতো সবাই। যেদিন ওদের ছাড়াছাড়ি হয় সেদিন আমার আরেক প্রিয় বন্ধুর সামনে নাকি তাপস হাউমাউ করে কেঁদেছে। প্রেমে হেরে গেলে নিগূঢ় অসহায়ত্বে পুরুষ কীভাবে ভেঙে পড়ে তাপসের কান্নার কথা শুনে আমি তা প্রথম বুঝতে পারি। পরে একবার কি একটা বিষয়ে ভুল বুঝে ওকে বাজে একটা বকা দিয়েছিলাম। ও তখন হৃদয় বিদারক কান্নায় আমাকে ভীষণ কাতর করে তুলেছিলো। ভুল বুঝতে পেরে আমি দুঃখ প্রকাশ করে মাপ চেয়ে নিয়েছিলাম। নিজেও কেঁদেছিলাম ওকে জড়িয়ে। বলেছিলাম এই দুঃখ ভুলে যাস তুই। ও আমাকে হাত বুলিয়ে বলেছিল- এই দুঃখ পাওয়াতে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে তাতে কখনো পঁচন ধরবে না, পুঁজ জমবে না। তরতাজা রক্ত বইবে সবসময়। যার অর্থ ছিলো এই বেদনার পরও আমাদের বন্ধুত্ব প্রবাহিত রক্তের মতোই তরতাজা থাকবে। তাপসের কান্নার তাৎক্ষণিক সততায় আজো আমি বিশ্বাস রাখি। পুরুষালি কান্নার অপূর্ব মোহনতা আমি খুঁজে পেয়েছি বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’য়। কান্নার সেই কাব্যিক রূপায়নের কথা আজ তাপস প্রসঙ্গে মনে পড়লো। যাই হোক, ওদের ছাড়াছাড়ির পর একটা কবিতা লিখি তাপসকে নিয়ে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই তো ভেঙে পড়ে, নষ্ট হয়ে যায়। কবিতা লিখে ওর মধ্যে শক্তি সঞ্চয়ের ইচ্ছে ছিলো আমার। বন্ধুত্ব একটা দায়বোধও তৈরি করে। কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন মনে আছে :
তপু সরকার
আর কেনো দুঃখ তোর?
খদ্দের পাঞ্জাবির গভীর ছেঁড়া পকেট থেকে
না হয় পড়ে গেছে সোনার আধুলিখানা।
কড়কড়ে টাকার গন্ধে নিমগ্ন মাতাল বুঁদ
তুই তো পাগল নোস
মেধাবি দীপ্তির তলে মগজে তোরও তো জানি
কৌস্তুভ মণি আছে
তুই কেনো ধসে যাবি একা একা?
স্রোতস্বিনী বারাঙ্গনা ইস্টার্ন প্লাজায় এসে মিশে গেছে
কেনো তাকে অর্থহীন কাছে ডাকিস?
মাঝের কোনো লাইন মনে পড়ে না আর। শেষের কয়েকটা লাইন ছিলো এরকম :
তবু আজ হতে হবে প্রসন্ন গণ্ডার
পরত চামড়া সমেত মুছে দিয়ে
সমুখের কুশাঙ্কুর সব
তপু, চোরাবালি পার হবো তুই, আমি
বড় জোর আমরাই।
শেষ পর্যন্ত দানা বাঁধেনি কবিতাটা। তাই গ্রন্থবদ্ধ করি নাই। তবে কবিতা দিয়ে জীবনের নিরাময় হয় না। অন্য কোনো ওষুধ লাগে। জীবন নিজের প্রয়োজনে সেই দাওয়াই মিলিয়ে দেয়। কান্নাকাণ্ডের পর একবার আমাকে চমৎকার একটা চিঠি লিখলো তাপস। ওর বাংলা এবং ইংরেজি হাতের লেখাও খুব সুন্দর। মিহিরের সঙ্গে তার সম্পর্কের আদ্যোপান্ত প্রাজ্ঞ কথার বিশ্লেষণে দারুণ ফুটিয়ে তুলেছে সে। যে কোনো পাঠককে ওর কথাগুলো সংবেদনশীল করে তুলবে। সাহিত্যিক পরিচর্যা থাকায় চিঠিটা আমি বহুদিন রেখে দিয়েছিলাম। এখন আর খুঁজে পাই না। তাপস বলেছিলো যদি প্রয়োজন পড়ে চিঠিটা আমি যেনো মিহিরকে পড়ে শোনাই। কান্নার ঘটনা বর্ণনাকারী আমার সেই প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে মিহিরের বাসায় গিয়েছিলাম। নাস্তা খাওয়ার ফাঁকে চিঠিটা পড়ে শোনাই ওকে। পুনরায় ওদের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরির পাঁয়তারা ছিলো আমাদের। চিঠি পাঠ শেষ হলে মিহির মুচকি হাসলো। তারপর একটু বিষণ্ন হয়ে বললো : আমাকেই লিখতে পারতো ও। বুঝছো নাসির, যে ক্ষমা করতে পারে না, যার উদারতা নাই তার সঙ্গে টিকবো ক্যামনে বলো? কোন প্রসঙ্গে ও এসব বলেছে তা ঘেঁটে দেখবার ফুসরৎ এবং ইচ্ছা কোনোটাই আমার ছিলো না। এই ঘটনার রেশ কেটে গেলে তাপস একদিন একটা মেয়ের ছবি নিয়ে এলো। বেশ সুন্দরী। ও যা বললো তার অর্থ হলো পরিবার ওকে বিয়ে করাচ্ছে। ছবির মেয়েটি পাত্রী। তারপর বিয়ে পরবর্তী রোমান্টিক বিষয়াদি নিয়ে কথা বললাম আমরা। স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গম প্রসঙ্গে এসে ঠেকলাম। তাপসের সেই যৌন উদ্দীপনা কল্পনায় অভিভূত করে তুললো তাকে। প্রেমে ব্যর্থতার বেদনা-উতরানো একটা উজ্জীবন আমি টের পেলাম ওর মধ্যে। মনে মনে ভাবলাম সঙ্গম কি বেদনা রহিত করে? সেই ভাবনায় কি তাপস বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে? ও বললো স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমের প্রস্তুতি রান্নাঘর থেকে শুরু করতে হয়। টুকটাক কাজে স্ত্রীকে সেদিন সাহায্য করা, ফাঁকফোঁকরে কামোত্তেজক কথা বলে আনন্দ দেওয়া। মোদ্দাকথা ওই দিন সার্বক্ষণিক একটা সঙ্গসুধা দান করতে হবে স্ত্রীকে। রাতের চরম পরিণতিতে দু’জনের সঙ্গম সুখ এতে নাকি ব্যাপকতর হয়। ‘বাৎসায়নের কামসূত্র’ এসব লিখেছে কি না, কে জানে? রীতিমতো শিল্পঘন একটা ব্যাপার স্যাপার। ছবির মেয়েটিকেই ও বিয়ে করেছে কি না, আমি জানি না। আমরা ৯৪’র পরীক্ষার্থী হলেও সেশন জটে দু’বছর পিছিয়েছি। ৯৬’র অনার্স পরীক্ষায় ও অংশ নেয় নাই। ড্রপ দিয়েছে। এরপর থেকে যোগাযোগ কমে এসেছে। মাস্টার্সের পর আর ওর সঙ্গে যোগাযোগ হয় নাই। ২০১২ তে ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক হিসেবে প্রেষণে পদায়ন পাই। অনেক কষ্টে কার কাছ থেকে যেন ওর নাম্বারটা জোগাড় করেছি। যখন ফোন দিলাম কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম ওর নির্বিকারত্ব দেখে। কোনো উচ্ছ্বাস নাই। বিস্ময় নাই। খুশির ভাবটিও নাই। ও যা বললো তার অর্থ হলো সব বন্ধুদের কথা ওর স্পষ্ট মনে আছে। কার কি রং, কার কি চেতনা বা এরকম কিছু। ঢাকায় কোথায় একটা ফ্ল্যাট আছে ওর, সম্ভবত কথার ফাঁকে সেটাও জানান দিলো। আর বললো ও খুব সফল মানুষ। সফলতা নিয়ে এই আত্মতুষ্টি ওর পূর্বতন স্বভাবকে স্মরণ করিয়ে দিলো। নিজের মেধা ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে ওর আত্মতুষ্টি আগেও দেখেছি আমি। যদিও সব কথায় বিশ্বাস পাইনি। বানিয়ে বলবার প্রবণতা তো ছিলোই। সেসব আমি সততার সঙ্গে এবং আন্তরিকভাবেই উপভোগ করেছি। উপাদেয় সেই অনুভবগুলো বরং কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করি আজো। আমার জীবনে ওর কিছু সময়ের উপস্থিতি আমার কাব্যপ্রতিভায় ভূমিকা রেখেছে। এ কথা স্বীকার করি দ্বিধাহীন। যদিও আমার কবিতার ব্যাপারে সরাসরি সে কোনো অবদান রাখে নাই। কে কীভাবে কবিতায় প্রভাব ফেলে তা সব সময় দৃশ্যমান নয়। অধরা সত্য হিসেবে অনুভবে আসে। একবার ঈদের ছুটিতে ও আমাকে মহাখালি বাসস্ট্যান্ডে বিদায় জানাতে এলো। সে কি আবেগ! চোখে পানি আসার মতো। খুব সুন্দর গানের গলা ছিলো। বিশেষত রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং মান্নাদের গান ওর মুখে বেশি বেশি শুনেছি। নচিকেতার গানের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ওর মাধ্যমেই। ওই দিন বিদায়ের আগে ও প্রায় আবেগ জড়ানো কণ্ঠে গাইলো :
সোনার এ দিনগুলি জীবনের দিনগুলি ঝরে যায়
যাবে ঝরে….
সোনার দিন সব সময় ঝরেই যায়। যা আমরা ফিরে পাবো না তা অন্য কোনো প্রাপ্তিতে মিটিয়ে দেয় সময়। সম্পর্ক নিয়ে আমার অনেক কবিতাতেই নিজস্ব ভাবনা আছে। সাম্প্রতিক এক কবিতায় লিখেছি :
সম্পর্ক সংশয়গামী;
জমাট হয় না, বহুলাংশে গলে পড়ে।
মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে চাকরিকালীন বহুদিন পরের ওই ফোন কলে আমার মোবাইল নাম্বারটা ওকে দিয়েছিলাম। ও আজও যোগাযোগ করেনি।
২
মিথ বিশেষজ্ঞ, কারুশিল্পী এবং মৌবিজ্ঞানী আ. রাজ্জাক ভাই ছিলেন মূলত কবিতাবিরোধী। লোকজ চিকিৎসার ওপর তার একটা বইও আছে। বইটার নাম ‘হাইমেনোক্যামোথেরাপি’। তো আ. রাজ্জাক ভাই বলতেন : কবিদের মধ্যে দল পাকানোর একটা হিজড়ামি আছে। হিজড়ারা নিজেদের মধ্যে যেমন ঘুঁট পাকায়া থাকে, সেইরকম। এ নিয়ে তার সঙ্গে কতবার ঝগড়া হয়েছে আমার! একবার রাগ করে বলেই ফেললাম : কবিতা আপনের বিষয় না। ওষুধপত্র আর রোগ নিয়া থাকেন। কবিতায় আসেন ক্যান? আমি তো আপনের ফিল্ডে যাই না। ওষুধ আর রোগশোক নিয়া আমি কোনো কথা কই? তিনি স্টার সিগারেট খেতেন। আমার কথার আকস্মিকতায় চোখমুখ লাল হয়ে গেলো তার। বললেন : তোমার টনটনা ইগো বের হইয়া আসছে। এরপর সিগারেটে দম নিতে থাকলেন বেশিবেশি। স্টলে বসে দু’জনেই চা খেলাম আর পরস্পর রাগারাগি করলাম। তো আ. রাজ্জাক ভাই ফ্রয়েড ভালো বুঝতেন। আলাপে বেশি বেশি ব্যবহার করতেন ‘ইগো’ শব্দটা। মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যায় মর্ষকাম, হর্ষকাম, গূঢ়ৈষা ইত্যাকার বাংলা শব্দগুলো তার কাছ থেকে শিখেছিলাম। তিনি মনে করতেন পৃথিবীতে তিনজন মানুষ আধুনিকতা এনেছেন। নিউটন, ফ্রয়েড এবং কার্ল মার্ক্স। ‘রূপবান’ পালার ফ্রয়েডিয় ব্যাখ্যা নিয়ে চমৎকার একটা গদ্য তিনি ‘ঘুড্ডি’তে ছেপেছিলেন। তো তার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা হয়তো অম্লমধুর ছিলো। কবিতাবিরোধী কত কথাই তো তিনি বলতেন। অথচ আমার কবিতার আন্তঃঅনুপ্রেরণা হিসেবে আ. রাজ্জাক ভাই নীরবে নিভৃতে কাজ করে গেছেন, এ কথা খুব জোরালোভাবে বুঝতে পারি আজ। মৃত্যুর বেশ কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন আমি তার মধ্যে পৌঁছতে পেরেছি। এই পৌঁছতে পারাটাই তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের সূচক হয়ে আছে। নিজের কবিতায় একবার লিখেছি :
সম্পর্ক এমনই হয়, সকলে পরিধি
ফলে কেউ কেন্দ্রীভূত নয়।
আজ ভাবি, আ. রাজ্জাক ভাই এমনই পরিধি যার প্রতিটি বিন্দুই একেকটি কেন্দ্র হতে পারে। প্রায় বছর বিশেক আগের কথা বলছি। ময়মনসিংহ থেকে কবিকুল আসলেন আমাদের সঙ্গেে আড্ডা দিতে। আ. রাজ্জাক ভাইয়ের বাসায় আড্ডা দিয়ে আমরা ঘুরতে বের হলাম। ঘুরতে ঘুরতে মাঝিপাড়ার পশ্চিমে বহুদিনের পুরনো ‘ভাটক্ষুরা’ গাছের দিকে দৃষ্টি পড়লো আমাদের। আ. রাজ্জাক ভাই বলতেন ওই গাছ আড়াই বা তিন হাজার বছর আগের। মাঝে মধ্যেই তার কথায় সত্য-মিথ্যার টানাপোড়েন তৈরি হতো। আমরা হকচকিয়ে যেতাম। কিন্তু তার কথার নান্দনিকতা এতটা বিহ্বল করে দিতো যে, বিস্মিত হলেও চুপ থাকতাম আমরা। কবি সাঈফ ইবনে রফিক ‘ভাটক্ষুরা সিরিজ’ কবিতা লিখেছিলো। এই বৃক্ষ দেখার স্মৃতি হয়তো তার ভিতরে কাব্য-প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। তো ‘ভাটক্ষুরা’ দেখে মাঝিপাড়া এলেই ডান পাশে বড় একটা বাঁশঝাঁড় চোখে পড়লো। সন্ধ্যার খানিকটা আগে গোধুলির বিষণ্নতা আমাদের কলহাস্যে ছিটকে পড়ছিলো মনে হলো। সামনে কালি মন্দির। পাশেই গোরস্থান। আমরা নিভৃতি ভাঙছি। বাঁশঝাঁড়ে নৈঃশব্দ্য ভাঙছে একটা কাঠঠোকরা। যতদূর মনে করতে পারি বাঁশঝাঁড় ঘেঁষে মাঝি পাড়ারই কোনো একটা কম বয়েসি মেয়ে সম্ভবত ঘরের কোণে নির্বিকার দাঁড়িয়েছিলো। মনে হলো সে যেনো নিভৃতের প্রেমোদ্দীপনা। আ. রাজ্জাক ভাই কাঠঠোকরার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন : দেখছো মামুন, কেমন কটাশ কটাশ বাঁশ কাটতেছে? আমাদের কলহাস্যের মধ্যেও আমি যেনো পরম এক নৈঃসঙ্গ উপভোগ করছিলাম। নিভৃতের মধ্যে সাঁতরাচ্ছিলাম কবিতার সদ্য আবির্ভুত একটা ঘোরের আলোয়। ‘কটাশ কটাশ’ শব্দের দ্যোতনা আমার মধ্যে এমনভাবে কাজ করলো যে, বাকি পথটুকু নীরবে এগোলাম। একটা কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন লেখা হয়ে গেলো মনে মনে :
তার মনে এক নেই
বহুতত্ত্ব মাটির শেরেক
কটাশ কটাশ কাটে বাঁশকাটা পাখি
ঠোঁটে তার মনের পেরেক।
‘লখিন্দরের গান’ কাব্যগ্রন্থে কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত।
◾
কাজী নাসির মামুন
কবি ও প্রাবন্ধিক
সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, শহীদ স্মৃতি সরকারি কলেজ, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।
জন্ম : ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।
সমকালীন বাংলা কাব্যসাহিত্যের এক অপরিহার্য নাম।