এই সময় প্রচুর ভালো কবিতা কি লেখা হচ্ছে? যদি হয়, তাহলে, ভালো কবিতা বুঝে নেয়ার রিক্টারস্কেল-ই বা কী? কোন সংজ্ঞায় একটি কবিতা ভালো বলে, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। আমাদের কাছে, সেইসব কবিতা তৈরির রেসিপি জানা থাকলে না হয়, তাই দিয়ে ঘেঁটেঘুঁটে রাঁধুনীর মশল্লায় মজার সব কবিতা রান্না করে আয়েশযোগ্য খাবারের ডাইনিংয়ে সাজিয়ে দিতে পারতাম।
যদি বলি, কবিতা কবির ভেতরে সংগঠিত বোধ ও অভিজ্ঞান। তা-ও জানি, এ-ও কবিতার রহস্যের তরফে সার্বিক ব্যাখ্যা নয়। কবিতা কি তাহলে? আত্মায় ত্রি-ব্যক্তিতে এক— ঈশ্বর! না-কি? বায়নোকুলারে প্রকৃত দেখার অভিজ্ঞতা থেকে দুঃখ-আনন্দ, বেদনায় জর্জরিত একেকটি লেখাই হয়তো হতে পারে সার্থক কবিতার প্যারাগ্রাফ। যে দেখায় কেবল, কবির নিজস্ব নয় অন্যেরও বোধ-বোধিসত্বের চিন্তা ও মেধার প্রতিফলন ঘটে। তাই, কবিতার সব অনুভূতি কবির একান্ত নিজের উত্তাপ নয়। অন্যেরও হতে পারে। না, তবুও তো কবিতার আরো অনেক স্বপ্ন— অসীম সূত্র থাকে…। ঘোরলাগা সুষম ছন্দের বিন্যাসও থাকতে হয়। এর পরেও যে, বলতে হবে— প্রকৃত কবিতার কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞা হয় না, বৃত্তও থাকে না।
তবুও— মিডিয়ায় ভালো কবিতা চাই। প্রতিনিয়ত দৈনিকের সাপ্লিমেন্ট এবং ছোটকাগজগুলো ভালো কবিতা ছাপাতে ব্যর্থ… এ রকম প্রশ্নের মুখোমুখি এখন আমরা সর্বদাই। তবে, কেনো আমাদের কাব্যশিল্পের এমোন দৈণ্যদশা? আর এজন্য দায়ি কি তাহলে মিডিয়ার কালো থাবা? আমাদের দেশে হঠাৎ করেই বহু দৈনিক গজিয়ে ওঠায়, তাদের রিলেটাকে সিদ্ধ করতে কিংবা অনেক উপভোগ্য সাময়িকী ছাপানোর আয়োজন করতে, যে পরিমাণ মিডিয়াজনিত লেখা নেয়ার চাপ। এবং আজকাল যে হারে, অনেক লেখা ছাপার ইচ্ছা কবির মধ্যে ক্রিয়া করছে, ঠিক সেই পরিমাণ ভালো কবিতা লেখার তাগিদ কি কবির আত্মায় জন্মাচ্ছে কি-না? এই হিসেবটাও বোধহয় ভালো লেখা হওয়া, না হওয়ার ক্ষেত্রে ভেবে নেয়াটাও খুব বেশি জরুরী। এরপর মিডিয়ার যে অংশে কবিতার ছাটাই-বাছাই হয়, তারাই বা কতোটা কবি? কিংবা তারাও কতোটা কবিতাতাড়িত আন্তরিকতায় আবৃত এবং এরাই বা, কতোটা পরীক্ষিত শিল্পের মানসিকতায় প্রতিনিয়তো ভোগ্য হচ্ছে? বিষয়টি আজকাল ছোটকাগজ/ বড়কাগজ উভয় কাগজের সম্পদনার ক্ষেত্রেই ভেবে দেখা প্রযোজ্য। একজন প্রকৃত কবির স্বচ্ছতার চেয়ে একজন সম্পাদকের বায়নোকুলার লেন্স কতোটা স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ এবং তিনি কতোটুকুই বা কবিদের কবি? এ-ও তো ভাবতে হবে। ভালো লেখা হওয়ার ক্ষেত্রে, এটাও এখন ভাবা কি খুব জরুরী বিষয় নয়?
প্রতিনিয়ত দৈনিকের সাপ্লিমেন্ট এবং ছোটকাগজগুলো ভালো কবিতা ছাপাতে ব্যর্থ… এ রকম প্রশ্নের মুখোমুখি এখন আমরা সর্বদাই। তবে, কেনো আমাদের কাব্যশিল্পের এমোন দৈণ্যদশা? আর এজন্য দায়ি কি তাহলে মিডিয়ার কালো থাবা?
আমার তো মনে হয়, এখনকার সাহিত্য সম্পাদকদের অন্যতম ভাষা হলো পৃষ্ঠা ভরে তাকে প্রমাণ করা যে, সে কতোটা মিডিয়া ও সাময়িকীর সৌন্দর্য রোপন করতে পারলো। এটা মূলতঃ ওদের পৃষ্ঠাই থাকা না-থাকার উদ্দেশ্য। সম্পাদক পদের চাকরীতে বহাল থাকা না-থাকার কিংবা আরো ভাবতে হবে, আমরা যে মিডিয়ার কথা বলছি, তাদের চরিত্রের কমিটমেন্ট কি ? সে কি কবিতার মতো শুদ্ধ শিল্পের ধারক? না-কি, ধর্ষণজনিত স্টোরি ও নায়িকাদের নগ্ন ছবির প্রচারক। যেহেতু মিডিয়া বরাবরই যৌন উত্তেজনা ছাপিয়ে কাটতি পায় অনেক— মিডিওকার তখন সেদিকেই নজর দেন খুব বেশি। ফলে, আমরা হয়তো কবিতার সেই কাঙ্খিত রূপ মিডিয়ার মাধ্যমে খুঁজে পাচ্ছি না। একেবারেও পাচ্ছি না, এমোন কিন্তু নয়। কবি আহসান হাবিবের ‘রবিবাসরীয়’, কখনো ‘সংবাদ সাময়িকী’তে এবং ‘খোলা জানালা’ নামের সাহিত্য পাতায় কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের সম্পাদনায় বহু ভালো কবিতার বিবিধ পংক্তি খুঁজে পাওয়ার ইতিহাস ও আনন্দ উভই অনেক আছে। কিন্তু সেইসব সম্পাদকের… সম্পাদনার তুলনা কই— কোথায় আজকাল?
মুহূর্তেই কবিতা লেখার নানা কারিগরী প্রচেষ্টায় নন্দন বিবর্জিত টিমগেমের কসরত কিছুটা সহজ হলেও হতে পারে
সে যাক, মিডিয়া মূলত অবসর যাপনের তরল মনোরঞ্জনের ওয়াইন ভাবাই শ্রেয়। যদিও, পশ্চিমবঙ্গে শিল্পকে মারাত্মক রকম কুক্ষিগত মানসিকতার কিছু প্রতিষ্ঠান থাকলেও— এ দেশের শিল্প-সাহিত্যের যা কিছু (কবিতাও) পুরোপুরি বাণিজ্যিকভাবে মিডিয়ার খপ্পরে আসেনি। এবং তেমন মামদোভূতের কোনো প্রতিষ্ঠানও তৈরি হয়নি আজও— যদিও ‘শিল্পকে’ পূঁজিতান্ত্রিক আইডিয়ার মাধ্যমে শপিং— ট্রেন্ডগুলোর খপ্পরে ফেলে এখনো আমাদের দেশের সাহিত্যকে সম্পূর্ণ বিক্রয়যোগ্য করে তুলতে পারেনি। ফলে, কিছুটা জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে, হলেও এখনকার প্রত্যেক দৈনিকের সম্পাদকের সৌহার্দ্য এবং স^-স্ব ক্ষেত্রে একে-অন্যের আন্তরিকতা ও বন্ধন ভিত্তিক নেটওয়ার্কিং থাকা দরকার। তা-না হলে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়ে যায়/যাচ্ছে পাঠকের। সে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত হয়ে কবিতা পাঠের আনন্দ থেকে, হারিয়ে যায়— কবিতার শিল্প থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
তাছাড়া, আরো কিছু সমস্যা তো আছেই। ভাল কবিরা অহংবশে নিশ্চুপ থাকেন— কোনো কোনো কবি আবার মিডিয়াকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলেন। এতে— হামেশাই বঞ্চিত হচ্ছে ভালো লেখা পাঠের…পাঠকরা। কিন্তু এইসব ভাল কবি যদি মিডিয়াকে ভয় না পেয়ে— তুচ্ছ না ভেবে, মিডিয়াকে আক্রমণ করতো, তাহলে বোধ হয় মিডিয়ার সাহিত্য সম্পাদকরা ভালো কবিতা খুঁজে পাওয়ার দায় থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেতে পারত।
কবি তো সত্যদ্রষ্টা— ঈশ্বরের মতোই পূণ্যবান। তাহলে, এখানেও কেনো সৎ-অসতের আড়ম্বর? বাংলা কবিতার ইতিহাসে সংঘ-সৌহার্দ্যরে, খ্যাতি-অখ্যাতির, দ্বন্দ্ব-শ্লেষ, বিদ্বেষ এইসব মিলিয়ে নানা ডিগবাজী গল্পও তো লেগেই আছে। সেই রবীন্দ্র পরবর্তীকাল থেকে আজোব্দি চলছে তা-ও। কল্লোল, কবিতা, হ্যাংরি, ক্ষুধার্ত, সমকাল, কৃত্তিবাস কিংবা বলা যায়, বিউটি বোডিং বিসৃত নানা সংঘ-সৌহার্দ্যরে বেনোজলেও আমাদের কবিতার উর্বরতা— পুড়েই চলেছে খড়দাহের— তর্কে ও বিতর্কেরর অনলে। আপাতত : সেইসব ইতিহাসের বিতর্কিত পাণ্ডিত্য ফলাতে চাইছি না। শুধু সময়ের প্রত্যক্ষণ ছুঁতে— মুখোমুখি হতে হয় বলেই, বলতে হচ্ছে. আগের সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ানক তাপ ও বিদ্যুতে জ্বলছে আমাদের সংঘ ও সৌহার্দ্যতা। এখন তো গুরুমুখী কেউ কেউ কবিখ্যাতির যজ্ঞ— সাজিয়ে ধুঁমোয় কুণ্ডলি পাকিয়ে জিকির তুলছেন, নিজেই মহাকবি— নিজেরই মহার্ঘতা, নিজের আত্মসর্বস্বতা।
এক্ষেত্রে একজন ভাল কবি আল মাহমুদ কবিতাকে ধর্মের প্রলোভন দিয়ে যখন কবিতাকে একচেটিয়া রাজনীতিকরণের একগুচ্ছ সাম্প্রদায়িক সংজ্ঞা দিয়ে কবিতা নষ্টের ভ্রুণ ছড়াচ্ছিলেন, এটিও ছিল ভাল কবিতা নষ্টের ভয়ানক কাজ। তিনি তো, সময়ের তরুণ প্রজন্মকে আহবান জানাতেন, তিনি তো বলতেন, ‘‘…মুসলমানদের একটা জগত আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ইসলামি জগত পাশ্চাত্য সভ্যতা থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। এটাই এখনকার trend. যদি কোন তরুণ মুসলিম কবি লিখতে চান তা হলে এদিকেই তাকে অগ্রসর হয়ে যেতে হবে…।’’ তিনি আরও বললেন, ‘‘…তরুণ কবিদের ব্যাপারে আমার বিশ্বাস একদা কোরআন-কে তারা আঁকড়ে ধরবে বাঁচার জন্য এবং কোরআনকেই তারা প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে…’’। (যুগান্তর সাহিত্য : ১৭ জানুয়ারী ২০০৩) কবিতাকে ‘কোরআন’ করার এই আহ্বান, কবিতাকে সুন্নতে খাতনার এই যে প্রয়াস— কবিতাকে মুসলমান বানিয়ে কাব্যের মানবতাকে এভাবে আরোপিত কলঙ্কের এই যে নীলনকশার মোড়ক উন্মোচন, এ-ও কি? কবির সময়ের বিকৃত মানসিকতা নয়? এ-ও কি? তার ক্ষরণ মস্তিষ্কের ভীমরতিপ্রাপ্ত প্রচারণা? না-কি, মৌলবাদী ফতোয়ার আস্ফালন। এ-ও কি কবিতা নষ্টের ঘৃণ্য প্রচেষ্টা নয়? আজকের এই উন্মুক্ত বিশ্বায়নের যুগেও আমরা কেনো, কার স্বার্থে, কোন রাজনৈতিক টোপের কামড়ে— কবিতার মতো শুদ্ধ ও সর্বজনীন শিল্পের অবাধ বিচরণকে— কেনো? কোন দলীয় অধ্যায়ের মধ্যে সংকুচিত করে নেব? কার তত্ত্বে— কোন্ কাঁটাচামচের খোঁচায় আমরা কেনোই বা উপড়ে তুলবো, নষ্ট করবো, আমাদের শিল্পময় কাব্য-ঐতিহ্যের শেকড়।
প্রকৃত কবিতা নষ্টের প্রচেষ্টা তো এভাবেই শেষ নয়? রয়েছে কিছু লিটলম্যাগওয়ালাদের অহং-দেমাগ! যাদের আবিষ্কারে গুটিকয় নিজস্ব কবি-সাহিত্যিক শিল্পীরাই শ্রেষ্ঠ! ঐতিহ্যবিকৃত— বিবর্জিত স্ব-উদ্যোগের উচ্ছিষ্ট তত্ত্বের সার-শূণ্যতায় নিজেরাই কেবল নিজেদের প্রশংসা, পদক, শিরোপা ভাগ-বাটোয়ারা করেন/ করছেন। এবং নিজের অর্থের বিনিময়ে নিজেরাই নিজের কবিখ্যাতির বাগাড়ম্বর অনুষ্ঠান সাজাচ্ছেন, নিজেরাই নিজেদের বইয়ের সাক্ষ্য লেখাচ্ছেন। এরাই তো, দলে দলে নিজেদের সৌহার্দ্যরে বাইরে অন্যের লেখার অহেতুক নিন্দাস্তুতি করে এক ধরণের বিষ ছড়ান। এই সব ষড়যন্ত্রের কবলে পড়েও এখনকার বাংলাকবিতার উর্বরতা হারাচ্ছে— সন্দেহ নেই।
তবে, মহাকালকে অস্বীকার করে— মুহূর্তেই কবিতা লেখার নানা কারিগরী প্রচেষ্টায় নন্দন বিবর্জিত টিমগেমের কসরত কিছুটা সহজ হলেও হতে পারে। কিন্তু কবিতাকে শিল্পের সঠিক মাত্রায় তুলবার খেলায়, ওপেন টেনিসের একক ফাইনালে জাস্টিন জেনিনের বিজয় কিন্তু অতোটাও সহজ মোটেই নয়।